সিউড়িতে বাসস্ট্যান্ডের মুখেই আটকা পড়ল ধর্মঘটের সমর্থনে ডাকা মিছিল। পুলিশের সঙ্গে বাদানুবাদের পরে মিছিলের মুখ ঘুরিয়ে নিলেন জেলার বাম নেতৃত্ব।ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়
বেসরকারি বাস তেমন চলেনি। পরিবর্তে সরকারি বাস চলছে পর্যাপ্ত মাত্রায়। যেখানে সরকারি বাস নেই, সেখানে বাস না পেয়ে অসুবিধায় পড়লেন সাধারণ মানুষ। দোকানপাট অন্যান্য বারের চেয়ে অনেক বেশি খোলা ছিল। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে স্কুল কলেজ ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে হাজিরাও ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে ব্যাঙ্কের কিছু শাখা বন্ধ ছিল। পথেঘাটে মানুষও ছিল কম। দু’ একটি অপ্রীতিকর ঘটনা বাদ দিয়ে শুক্রবার দেশ জুড়ে ডাকা শ্রমিক ধর্মঘটে মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় দেখা দিল বীরভূমে। জেলাশাসক পি মোহন গাঁধীর দাবি, বিভিন্ন সরকারি কার্যালয়ে এ দিন কর্মীদের হাজিরা ছিল ৯৯.৩ শতাংশ।
মুরারইয়ে মার
ধর্মঘটের সমর্থনে এসইউসি-র শ্রমিক সংগঠনের মিছিল এগোচ্ছিল মুরাইয়ের হাটতলার দিকে। ঠিক তখনই উল্টো দিক চলে এল তৃণমূলের সিঙ্গর দিবসের মিছিল। দ্রুতই দু’পক্ষের মধ্যে শুরু হল বচসা। অচিরেই যা গড়াল হাতাহাতিতে। জখম হলেন পাঁচ ধর্মঘট সমর্থক। এসইউসি-র জেলা সম্পাদক মদন ঘটকের অভিযোগ, মিছিল থেকে বেরিয়ে তৃণমূল কর্মীরা পাঁচ দলীয় কর্মীকে মারধর করেছে। তাঁদের মধ্যে এক জনের মাথায় গুরুতর আঘাত লেগেছে। মিছিলের জন্য ভাড়া করা মাইক ও ভ্যান ভাঙচুর করেছে তৃণমূল কর্মীরা। মিছিলে হামলা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের মুরারই ১ ব্লক সভাপতি বিনয় ঘোষের দাবি, ‘‘একটা ভুল বোঝাবুঝি থেকে সামান্য গন্ডগোলের সৃষ্টি হয়েছিল। পরে দু’পক্ষ বসে মীমাংসা করে নিয়েছে।’’ ওই ঘটনায় পুলিশের কাছে এখনও অভিযোগ দায়ের হয়নি।
নজরে মহম্মদবাজার
ঠিক এক বছর আগে এ দিনই সিপিএমের মিছিলকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্রের চেহারা নিয়েছিল মহম্মদবাজার। সিপিএমের দলীয় কার্যালয়ে হামলা এবং তৎকালীন সাঁইথিয়ার বিধায়ক ধীরেন বাগদিকে মারধরের অভিযোগও উঠেছিল শাসকদলের বিরুদ্ধে। সেই ঘটনাকে মাথায় রেখে তৎপর ছিল পুলিশ-প্রশাসন। তাই শুক্রবার ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে এ বার আর কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এলাকার দোকান, ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিস, স্কুল, ব্লক অফিস খোলা ছিল। পাথর শিল্পাঞ্চল এবং প্যাটেলনগর খড়ি কোম্পানির কাজকর্মও স্বাভাবিক ছিল। তবে বেসরকারি বাস চলেনি। এমনকী, ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে অন্যান্য দিনের চেয়ে গাড়িও অনেক কম চলেছে। বামেরা এ বার মিছিল বের করেনি। কেন? সিপিএমের মহম্মদবাজারের জোনাল সম্পাদক প্রভাস মালের দাবি, ‘‘মহম্মদবাজার থানার ওসি আগের দিন ফোন করে মিছিল না করতে অনুরোধ করেছিলেন। শাসকদলও মিছিল করবে না বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতেই মিছিল না করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।’’ অন্যত্র মিছিল হলেও মহম্মদবাজার এলাকায় মিছিল করতে দেখা যায়নি তৃণমূলকে।
আবেদনেই জোর
পুরনো চেনা ছবিটার থেকে অনেকটাই আলাদা ছিল এ দিনের ধর্মঘট। প্রতি বারের মতো ভোর থেকেই রামপুরহাট স্টেশনে পতাকা হাতে রেল লাইনে বসে পড়তে দেখা যায়নি ধর্মঘট সমর্থকদের। রামপুরহাটে অফিস বা দোকান খোলার সময় তা জোর করে বন্ধ করতে ধর্মঘট সমর্থকেরা কোথাও জমায়েতও করেননি। উল্টে সকালে রামপুরহাট শহরে হাঁসনের কংগ্রেস বিধায়ক মিল্টন রশিদের নেতৃত্বে হওয়া মিছিলে কর্মীদের সাধারণ নাগরিকদের ধর্মঘটের সমর্থনে সাড়া দেওয়ার জন্য মৌখিক ভাবে আবেদন জানাতে দেখা যায়। সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সঞ্জীব বর্মন বলেন, ‘‘তারাপীঠে কৌশিকী অমাবস্যা উপলক্ষে বাইরে থেকে প্রচুর দর্শনার্থী এসেছেন। তাঁদের কথা ভেবে আমরা রেল অবরোধ করিনি। সিঙ্গুর দিবসের নামে একই দিনে সংঘর্ষে প্ররোচনা দিতে তৃণমূল পথে নেমেছে। তাই যে কোনও ধরনের ঝামেলা এড়াতে আমরা খালি পথে মিছিল করে জনগণের কাছে ধর্মঘটের সমর্থনে আবেদন রেখেছি।’’
রুখল মিছিল
সকাল ৮টা নাগাদ সাঁইথিয়ায় সিপিএমের দলীয় কার্যালয় থেকে মিছিল বের করা হয়। কিন্তু বড় পোস্ট অফিসের সামনে কয়েক পা এগোতেই পুলিশ সেই মিছিল আটকে দেয়। সিপিএমের জোনাল সম্পাদক জুরান বাগদির দাবি, ‘‘পুলিশ আগের দিন থেকে ফোনে মিছিল না করার জন্য বলেছিল। কিন্তু মিছিল করা আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। তাই মিছিল বের করেছিলাম। কিন্তু প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ মিছিল আটকে দেয়।’’ সাঁইথিয়ায় এ দিন ট্রেন ও সরকারি বাস চলেছে। অফিস, স্কুল, কলেজ খোলা থাকলেও হাজিরার সংখ্যা ছিল খুব কম। দোকান খোলা থাকলেও খদ্দের ছিল না বললেই চলে। রাস্তায় অন্য দিনের তুলনায় যানবাহন ও লোকজনও ছিল বেশ কম।
পুলিশের অনুরোধ
ধর্মঘটের সমর্থনে মিছিল করলে গ্রেফতার করে জামিন অযোগ্য ধারা দেওয়া হবে। সিপিএম নেতাদের অভিযোগ ছিল, দলের কর্মী-সমর্থকদের এমনই হুমকি দিয়েছিলেন জেলার ওসি, আইসি-রা। যদিও সিউড়ি, দুবরাজপুর ও অন্যান্য বেশ কিছু জায়গায় সিপিএম মিছিল করতে পেরেছে। সিউড়িতে বাসস্ট্যান্ডের মুখে অবশ্য সিপিএমের মিছিল আটকায় পুলিশ। সেই মিছিলে ছিলেন জেলা সিপিএমের শীর্ষ নেতারা। এ নিয়ে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রামচন্দ্র ডোমের সঙ্গে বাদানুবাদ হয় পুলিশের। পুলিশ মিছিলটি অন্য দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে অনুরোধ কর। পুলিশের অনুরোধ মানেন নেতারা। সকালে সিউড়ি বাসস্ট্যান্ডের সামনে ধর্মঘটের সমর্থনে থাকা এসইউসি-র সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের মৃদু ধস্তাধস্তি হয়। সিউড়ির বিএসএনএল অফিসের সামনে ধর্মঘটের সমর্থমনে পোস্টার ব্যানার ছিড়ে ফেলেন তৃণমূলের কর্মীরা।
হাজিরায় চমক
বার অ্যাসোসিয়েশনের রেজোলিউশন অনুযায়ী অন্যান্য বার সরকারি আইনজীবীদের আদালতে আদালতে উপস্থিত থাকতে দেখা যায়নি। যদিও এ দিনের ধর্মঘটের বিরোধিতা করে রামপুরহাটে সরকারি আইনজীবীরা হাজিরা ছিলেন। আদালতে কেস মুভমেন্টে নিজেরা উপস্থিতও হন। কিন্তু বিপক্ষে উকিল না দাঁড়ানোয় আদালতে কোনও মামলারই শুনানি হয়নি। প্রায় একই ছবি দেখা যায় বোলপুর ও সিউড়ি আদালতেও। কয়েকটি ক্ষেত্রে অবশ্য বেল মুভমেন্ট হয়েছে। অন্য দিকে, রামপুরহাটে পাঁচমাথা মোড়ে বড় পোস্ট অফিস ও শহরের বেশ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বন্ধ থাকলেও স্টেট ব্যঙ্ক এবং জেলা কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের শাখাগুলি বিভিন্ন জায়গায় খোলা ছিল।
পাশে থাকার ডাক
শ্রমিক ধর্মঘটের দিনই জেলার বিভিন্ন প্রান্তে সিঙ্গুর বিজয় দিবস পালন করল শাসকদল। সকালে রামপুরহাটে মন্ত্রী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কর্মীরা মিছিল বের করেন। পরে রামপুরহাট পাঁচমাথা মোড়ে আশিস বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে সিঙ্গুর নিয়ে আদালতের রায়ে এলাকার চাষি থেকে সাধারণ মানুষকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে থাকার আহ্বান জানিয়ে ধর্মঘটের বিরোধিতায় পাশে থাকার ডাক দেন মন্ত্রী। সিঙ্গুর দিবস পালনে এবং ধর্মঘটের বিরোধিতায় সকাল সকাল বোলপুরেও পথে নামে তৃণমূল।