মিনি ট্রাক। তাতেই বাঁশের মাচা বেঁধে নীচে ডাঁই করে রাখা মুখোশ, ধামসা-মাদল প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র। উপরে গাদাগাদি করে বসে থাকেন ছৌ শিল্পীরা। দ্রুত গতিতে সেই গাড়ি যে নিয়ন্ত্রণে রাখা দুসাধ্য হয়ে ওঠে, বারবার দুর্ঘটনায় তা মালুম হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না এই বিপজ্জনক যাত্রা। দুর্ঘটনায় শিল্পীদের মৃত্যু, জখম হওয়াও লেগেই রয়েছে।
সোমবার রাতে কাশীপুর যাওয়ার পথে পুঞ্চা থানার বুধপুর সেতুর বাঁকে বরাবাজারের কুটরার ছৌ দলের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ার পরে শিল্পীদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি ফের সামনে এসেছে।
চলতি বছরের ৫ জানুয়ারি বোরো থানার বারি গ্রামের আরেক ছৌ শিল্পী উমেশ মাহাতো নাচের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে পানাগড়ের কাছে গাড়ি উল্টে প্রাণ হারান। কয়েক বছর আগে বরাবাজারের লটপদা গ্রামে এ ভাবেই এক রাতের দুর্ঘটনায় সাতটি প্রাণ চলে গিয়েছিল। ওই ছৌ দল আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। মাঝখানে ছৌ শিল্পীদের আরও কয়েকটি গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে। তাতে কেউ প্রাণ হারান, আবার অনেকেই চোটের জেরে গুরুতর জখম হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন।
ছৌ শিল্পীদের গাড়ি এ ভাবে বারবার দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন কেন?
লোক শিল্প নিয়ে শহুরে মানুষের উৎসাহ বাড়লেও শিল্পীদের রোজগার বিশেষ বাড়েনি। এখনও ছৌ শিল্পীদের আগেকার মতোই জমিতে দিনমজুরি করে কিংবা সামান্য জমিতে চাষবাসেই দিন গুজরান করতে হয়। দিনভর মাঠেঘাটে খেটে সন্ধ্যায় ছৌ নাচের মহড়ায় যোগ দেন তাঁরা। দলের নাম ডাক অনুসারে বাইরে পালা দেখানোর বায়না মেলে। সাধারণত দুর্গাপুজোর সময় থেকে চাষের মরসুম শুরু না হওয়া পর্যন্ত বাইরে নাচ দেখাতে যান। চাষ শুরু হলেই সবাই ফের চাষাবাদে মেতে যান। ফলে তাঁরা এখনও সুদিনের মুখ দেখতে পাননি।
মানবাজার থানার জনড়া গ্রামের বাসিন্দা বিশ্ববিকাশ রায় মাহাতো একটি ছৌ দলের পরিচালক। ক্যানিং, কাকদ্বীপ-সহ দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিভিন্ন এলাকায় তাঁর দল নাচ দেখিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, ‘‘খরচ অনুযায়ী নাচের জন্য তেমন টাকা উদ্যোক্তারা দেন না। ধরা যাক কোনও জেলার অনুষ্ঠানে গিয়ে ২০ হাজার টাকা মিলল। কিন্তু যাতায়াত ও খাওয়াদাওয়া বাবদ খরচই হয়ে যায় ১৫ হাজার টাকা খরচ। বাকি টাকা শিল্পীদের গুণমান বিবেচনা করে সাম্মানিক হিসেবে দেওয়া হয়। তাতে এক-একজন শিল্পী ২০০ থেকে ৩০০ টাকার বেশি পান না।’’
তিনি জানান, প্রতি দলে ২৫-৩০ জন শিল্পী থাকেন। মুখোশ ও বাদ্যযন্ত্রও কম নয়। এ জন্য অন্তত দু’টি মিনি ট্রাকের প্রয়োজন। কিন্তু যা টাকা পাওয়া যায়, তাতে দু’টি গাড়ির ভাড়াও ওঠে না। তাই বিপজ্জনক জেনেও শিল্পীদের একটি গাড়িতেই ঠাসাঠাসি করে নিয়ে যেতে হয়।
বোরো থানার মলিয়ান গ্রামের বাসিন্দা ঝুমুরিয়া বলে পরিচিত হংসেশ্বর মাহাতোর সঙ্গে এলাকার কয়েকটি ছৌ দলের যোগাযোগ রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘দক্ষিণ পুরুলিয়ায় বহু গ্রামেই প্রতিভাবান ছৌ দল রয়েছে। তাঁদের রক্তে সংস্কৃতি মিশে রয়েছে। নাচের বায়না পেলেই হল। খরচ বাঁচিয়ে তাঁদের হাতে খুব একটা পয়সা থাকে না। তবু একটি গাড়িতে ঝুঁকির যাত্রা জেনেও বাইরে যাওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না তাঁরা।’’
জেলার অন্যতম লোক গবেষক কাশীপুর মাইকেল মধুসূদন মেমোরিয়াল কলেজের শিক্ষক ক্ষীরোদ মাহাতোর আক্ষেপ, ‘‘অনুষ্ঠান বাবদ ছৌ শিল্পীরা ন্যায্য পারিশ্রমিক পান না। খরচ কমাতে ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও খোলা গাড়িতেই যাতায়াত করে থাকেন। তাই বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে।’’ এক ছৌ শিল্পী জানান, যাতায়াতের ভাড়া কমাতে অনেক সময়ে নড়বড়ে গাড়ি নিয়েও তাঁদের বেরোতে হয়।
রাজ্য সরকার লোক শিল্পীদের নিয়ে নানা প্রকল্প হাতে নিলেও কেন দিন বদলাচ্ছে না ছৌ শিল্পীদের?
পুরুলিয়ার জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক উৎপল পাল বলেন, ‘‘সরকারি উদ্যোগে ছৌ নাচের দল ভিন্ জেলায় গেলে সে ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম অনুসারে তাঁরা পারিশ্রমিক পান। তাঁদের যাতায়াতের ব্যাপারটা দুই জেলার তথ্য দফতর দেখাশোনা করে।
কিন্তু জেলায় এমন অনেক দল রয়েছে, তাঁরা কোথায় ক’দিনের জন্য অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছেন, সে খবর আমাদের দেন না। ফলে আমরাও জানতে পারি না। দুর্ঘটনায় শিল্পী প্রাণ হারালে তখন সরকারি ভাবেআর্থিক সহায়তা চেষ্টা করা হয়।’’
তবে সমস্ত ছৌ দলের এক জোট হয়ে নিজেদের স্বার্থেই ন্যূনতম পারিশ্রমিক ঠিক করা যে প্রয়োজন তা মানছেন অনেক শিল্পীই। তাঁদের মতে, তা না হলে অল্প টাকাতেই নাচের বায়না করানো হবে। ছোট্ট গাড়ির ঝুঁকির যাতায়াতও তাহলে বন্ধ হবে না। প্রিয়জন না ফেরা পর্যন্ত বাড়ির লোককে সেই উদ্বেগ নিয়েই প্রহর গুনতে হবে।