‘ডাক্তারবাবু’ নামে সুপরিচিত ছিলেন তিনি। কংগ্রেস কর্মীরা তো বটেই, রাজনীতির সংসর্গে থাকেন না এমন অনেকেই মানেন, এলাকার রাস্তাঘাট, সেতু, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, গ্রামীণ এলাকায় পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে স্কুল-কলেজ তৈরির মতো নানা উন্নয়নমূলক কাজে তিনিই ছিলেন অন্যতম কারিগর। সেই ডাক্তারবাবু আর নেই। কিন্তু, তাঁর সময়ে শুরু হওয়া উন্নয়নের কাজ-ই এ বারের ভোট প্রচারে অন্যতম হাতিয়ার বাম-কংগ্রেসের জোটপ্রার্থী মোর্তজা খানের। প্রার্থীর কথায়, ‘‘সেই ধারাই বজায় রাখব।’’
রাজ্যের বিধানসভা আসনগুলির মধ্যে শেষ, অর্থাৎ ২৯৪ নম্বর আসন মুরারই। এই কেন্দ্রে ১৯৬৭ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ডাক্তারবাবু অর্থাৎ মোতাহার হোসেন প্রতিদ্বন্ধিতা করেছেন। তার মধ্যে ১৯৬৭, ১৯৬৯, ২০০১, ২০০৬ এই চারবার তিনি পরাজিত হয়েছিলেন। তবে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯৬ টানা ছয় বার জয়ী হন। ২০১১ সালেও তৃণমূল-কংগ্রেসের জোট প্রার্থী নুরে আলম চৌধুরীর সমর্থনে হুড খোলা জিপে চেপে চাতরায় প্রচার করতেও দেখা গিয়েছিল জনপ্রিয় ডাক্তারবাবুকে। এ বারই প্রথম ভোট-ময়দানে নেই।
২০১১ সালে সিপিএম প্রার্থী কামরে এলাহি ৪,৪০৩ ভোটে কংগ্রেস-তৃণমূলের জোট প্রার্থী নুরে আলম চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন। এ বার কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়া হয়েছে বামফ্রন্টের। প্রার্থী রয়েছে কংগ্রেসের। বামফ্রন্টের সঙ্গে গাটছড়ার আবহে কংগ্রেস পুরনো আসনে জয় চাইছে। অন্য দিকে, কংগ্রেস, সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক, বিজেপি-র ভোট ভাঙিয়ে জয়ের আশায় তৃণমূলও। দল সাংগঠনিক দিক থেকেও শক্তিশালী, দাবি তৃণমূল নেতাদের। দ্বিতীয়বার জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী তৃণমূল নেতারা। এ বার তৃণমূল প্রার্থী করেছে মুরারই ১ ব্লক কংগ্রেসে প্রাক্তন সভাপতি তথা ২০১৩ সালে নলহাটি বিধানসভার উপনির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী আবদুর রহমানকে (লিটন)। কংগ্রেসের ভোটে ভাগ বসাতেই এমন কৌশল মনে করছেন অনেকেই।
মুরারই বিধানসভা এলাকায় মুরারই ১ পঞ্চায়েত সমিতির মুরারই, চাতরা, গোঁড়সা, রাজগ্রাম, মহুরাপুর, ডুমুরগ্রাম, পলসা এই সাতটি গ্রাম পঞ্চায়েত এবং মুরারই ২ ব্লকে পাইকর ১, পাইকর ২, মিত্রপুর, জাজিগ্রাম, নন্দীগ্রাম, আমডোল এই ছটি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। মোট ১৩টি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে এই বিধানসভার মোট ভোটার ২,৩৪,০৭৫ জন। মহিলা ভোটার ১,১৪,২৭৫। মোট বুথ ২৬৯।
২০১১ সালে হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি নুরে আলম চৌধুরী কংগ্রেস-তৃণমূলের জোট প্রার্থী হিসেবে জিতেছিলেন। মন্ত্রীও হন। এলাকার তৃণমূল কর্মীদের অভিযোগ, জেতার পরে এলাকাবাসীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি নুরে। পঞ্চায়েত সমিতি থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত বা জেলা পরিষদ সদস্যদের যোগাযোগ না রাখায় উন্নয়ন তেমন হয়নি একান্তে তা মানেন এলাকার অনেক তৃণমূল নেতা। সুযোগ বুঝে সেই মর্মে জোর প্রচার চালাচ্ছে কংগ্রেস-সিপিএমও।
এই প্রসঙ্গেই চলে আসছে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের বৃত্তান্ত। মুরারই ২ ব্লকের এক নেতার কথায়, ‘‘এলাকায় মন্ত্রীর গোষ্ঠীর বলে এখনও অনেক তৃণমূল কর্মী আছেন। তাঁরা আখের গোছানো ছাড়া আর কিছু বোঝেননি।’’ অনেকের মত, পঞ্চায়েত স্তরে ক্ষমতা দখল, একশো দিনের প্রকল্প, ইন্দিরা আবাস গৃহ নির্মাণ, বার্ধক্য ও বিধবা ভাতা, রাস্তা নির্মাণের মতো বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প নিয়ে মুরারইয়ে তৃণমূলের মধ্যে দ্বন্দ্বের শুরু। অভিযোগ, শুধু নুরে আলম চৌধুরীর গোষ্ঠী নয়, কেউ মৎস্যমন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহের (মুরারই বিধানসভার কলহপুর গ্রামে বাড়ি) গোষ্ঠী, কেউবা মুকুল রায় পন্থী গোলাম মোর্তজা গোষ্ঠী, কেউবা অনুব্রত মণ্ডল অনুগামী বিনয় ঘোষ গোষ্ঠীর লোক হিসাবে দ্বন্দ্বে জড়ান। সেই দ্বন্দ্বের কারণেই মুরারই কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী অনেকের না পসন্দ বলে অভিযোগ।
তৃণমূল নেতাদের চিন্তায় রাখছে ভোটের অঙ্কও। গত পঞ্চায়েত ভোটে মুরারই ১ পঞ্চায়েত সমিতিতে জেলা পরিষদ এর দুটি আসনের মধ্যে তৃণমূল একটিতে জেতে। সিপিএম পেয়েছিল অন্যটি। মুরারই ২ পঞ্চায়েত সমিতিতে জেলা পরিষদের তিনটি আসনে মধ্যে কংগ্রেস পেয়েছিল একটি বাকি দু’টি পেয়েছিল সিপিএম। লোকসভা ভোটের হিসেবে মুরারই বিধানসভায় কংগ্রেস ২২ শতাংশ ভোট পেয়েছে। বামেদের সঙ্গে সেই শতাংশ যোগ করলে দাঁড়াচ্ছে ৫৫.২১ শতাংশ। সেখানে তৃণমূলের ৩১.৮৬ শতাংশ। যা অনেকটাই কম। তার উপরে রয়েছে অনুন্নয়নের মতো অভিযোগ!
তৃণমূল প্রার্থী আবদুর রহমান অবশ্য দাবি করছেন, ২০১৪ সালের পরে অনেক কংগ্রেস, বামফ্রন্ট কর্মী তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। ফলে আগের অঙ্ক পুরনো হয়ে গিয়েছে। দ্বন্দ্বের কথাও মানতে চাননি প্রার্থী। তিনি বলছেন, ‘‘সকলে মিলে একসঙ্গে কাজ করছি।’’
অন্য দিকে, জোট প্রার্থী আলি মোর্তজা খানের অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল নেতাদের ঔদ্ধত্য, দুর্নীতিতে এলাকার মানুষ জেরবার। তাই জোটবদ্ধ হয়ে সকলেই তৃণমূলকে সরাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।’’ মুরারই ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি সিপিএমের আলি রেজা যোগ করছেন, ‘‘পঞ্চায়েত, লোকসভা ভোটের নিরিখে তৃণমূল অনেক পিছিয়ে। সেটা ব্যবধান আরও বাড়াতে নিচুতলার কর্মীরা একসঙ্গে জোর প্রচার চালাচ্ছেন।’’
তবে কাঁটা রয়েছে বামেদের জন্যেও। জেলা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অনেকের পর্যবেক্ষণ, মুরারই কেন্দ্রে কংগ্রেসকে আসন ছেড়ে দেওয়ায় বামেদের অনেকে ক্ষুব্ধ। কেউ প্রার্থী নিয়েও ক্ষোভ জানিয়েছেন। এঁদের এক জনের কথায়, ‘‘সেই কারণেই অনেক বামপন্থীদের এখনও সক্রিয় ভাবে প্রচারে নামতে দেখা যায়নি।’’