প্রতীকী ছবি।
জেলাকে তিন দিক থেকে ঘিরে থাকা ঝাড়খণ্ডের বিধানসভা ভোটে বিজেপির পরাজয়ে উল্লসিত পুরুলিয়ার কংগ্রেস ও তৃণমূল নেতৃত্ব। তাঁদের দাবি, ঝাড়খণ্ডের ভোটের প্রভাব পুরুলিয়ার রাজনীতিতেও পড়বে। যদিও তা খারিজ করে দিয়েছেন পুরুলিয়ার বিজেপি নেতৃত্ব।
পুরুলিয়া জেলায় কার্যত শূন্য থেকে গত ক’বছরে বিজেপির বিরাট উত্থান ঘটেছে। সে জন্য পাশের তৎকালীন বিজেপি-শাসিত ঝাড়খণ্ড রাজ্যের প্রভাব ছিল বলে একান্তে স্বীকার করতেন তৃণমূল নেতারা। ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের ফলেই তার ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তৃণমূলের সঙ্গে টক্কর দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিল বিজেপি।
জেলার ১৭০টি পঞ্চায়েতের ১৯৪৪টি আসনের মধ্যে (একটি আসনে ভোট হয়নি) যেখানে তৃণমূলের ঝুলিতে যায় ৮৬০টি, সেখানে বিজেপি পেয়েছিল ৬৪৪টি। জেলার ২০টি পঞ্চায়েত সমিতির মধ্যে ৫টিতে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায় বিজেপি। জেলা পরিষদের ৩৮ আসনের মধ্যে বিজেপি উঠে আসে শূন্য থেকে আটটিতে। এ ছাড়া একাধিক পঞ্চায়েত সমিতিতে শাসকদলের সঙ্গে কোথাও সমানে টক্কর দিয়েছে, কোথাও বা সামান্য এগিয়েও থেকেছে। পরে অবশ্য কিছু সদস্যের দলবদল-সহ নানা ঘটনায় পরে তিনটি পঞ্চায়েত সমিতিতে শেষ পর্যন্ত বিজেপি বোর্ড গঠন করে।
পঞ্চায়েত নির্বাচনে নজর কেড়েছিল প্রাক্তন সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতোর নিজের এলাকা বলরামপুরে তৃণমূলের ‘ভরাডুবি’। ঘটনাচক্রে সেই বলরামপুরের পাশেই ঝাড়খণ্ড। বাকি যে চারটি পঞ্চায়েত সমিতিতে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল, সেই সাঁতুড়ি, রঘুনাথপুর ১, রঘুনাথপুর ২, পাড়ার মধ্যে কোনওটি ঝাড়খণ্ড ঘেঁষা, কোনওটি বা কিছুটা দূরে। এক বছর পরে লোকসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে জেলার ন’টি বিধানসভার মধ্যে মানবাজার বাদে বাকি আটটিতেই এগিয়ে যায় বিজেপি।
পুরুলিয়ায় বিজেপির এই উত্থানের নেপথ্যে ঝাড়খণ্ডের দলীয় সহযোগিতার হাত অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন জেলা রাজনীতির ওঠাপড়ার নিয়মিত পর্যবেক্ষকেরা। তাঁরা মনে করাচ্ছেন, তৃণমূলের কিছু নেতার আচরণ ও জনবিচ্ছিন্নতা নিয়ে মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে এবং পড়শি রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে পঞ্চায়েত ভোটে সুফল পেয়েছিল জেলা বিজেপি। এ ছাড়া, পঞ্চায়েত ভোটে মনোনয়ন পর্বে তৃণমূল যাতে বাধা দিতে না পারে সে জন্য বলরামপুর-সহ কিছু এলাকায় ঝাড়খণ্ড থেকে বিজেপির লোকজন ঢুকেছিল বলে অভিযোগ উঠেছিল। যদিও তা জেলা বিজেপি নেতৃত্ব অস্বীকার করেন। লোকসভা ভোটেও বারবার ঝাড়খণ্ডের বিজেপি নেতাদের এসে লড়াইয়ে দলের জেলা নেতৃত্বের পাশে থাকার বার্তা দিতে দেখা গিয়েছে।
পুরুলিয়া জেলার সঙ্গে ঝাড়খণ্ডের সীমানা প্রায় ৩৮০ কিলোমিটার। পৃথক রাজ্যের সীমানা মাঝে থাকলেও দুই রাজ্যের মানুষজনের সামাজিক জীবনযাপন কার্যত একই। আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে দু’পাশের মানুষদের মধ্যে। তেমনই বাজার-হাট থেকে চিকিৎসা— নানা প্রয়োজনে দুই রাজ্যের মানুষ যাতায়াত করেন। ফলে এক রাজ্যের রাজনীতির প্রভাব পাশের রাজ্যের মানুষের মধ্যে কিছুটা হলেও প্রভাব ছড়ায় বলে মনে করছেন রাজনীতির কারবারিরাও।
ঝাড়খণ্ডে জেএমএম-এর জোটসঙ্গী হিসেবে কংগ্রেসও সুফল পেয়েছে। তাতে উচ্ছ্বসিত ঝাড়খণ্ড লাগোয়া বাঘমুণ্ডির কংগ্রেস বিধায়ক তথা জেলা কংগ্রেস সভাপতি নেপাল মাহাতো। তিনি দাবি করেন, ঝাড়খণ্ডের এই ভোট বার্তা দিয়েছে, বিজেপি আর যাই হোক, দলিত বা আদিবাসী মানুষের কথা বলে না। কেবলমাত্র ভোটের স্বার্থে ব্যবহার করে। তাঁর মতে, ‘‘ঝাড়খণ্ডের একটা বিস্তীর্ণ এলাকার সঙ্গে পুরুলিয়ার মানুষের মনের মিল খুব বেশি। তাই ঝাড়খণ্ডের মানুষ বিজেপির দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন মানেই, এ রাজ্যেও নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের দল বিশেষ সুবিধা করতে পারবে না। ঝাড়খণ্ডের মতো এখানেও কংগ্রেসেই মানুষ আস্থা রাখবেন।’’
তৃণমূলের জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতোও দাবি করেন, ‘‘বিজেপি এখানে কয়েকটি পঞ্চায়েত ও লোকসভা কেন্দ্র জেতার পরে ওদের লোকেদের যে ঔদ্ধত্য মানুষ দেখছেন, তার জবাব ঝাড়খণ্ডের মানুষ দিয়েছেন। এখানেও উপনির্বাচনে ওরা শিক্ষা পেয়েছে। বিধানসভা ভোটে বিজেপি তল্পিতল্পা গোটাবে।’’
বিজেপির পুরুলিয়া জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী দাবি করছেন, ‘‘ঝাড়খণ্ডের ফলাফলে এ রাজ্যে কোনও প্রভাব পড়বে না। ঝাড়খণ্ডে তো অনেকদিন বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে। প্রভাব থাকলে এত দিন এ রাজ্যে তৃণমূল থাকতই না। ঝাড়খণ্ডে কিছুটা হলেও প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বিষয় ছিল। কিন্তু এখানে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার সুবিধা বিজেপি পাবে। এ রাজ্যে বিজেপির ক্ষমতায় আসা কেউ আটকাতে পারবে না।’’