পাইকর গ্রামে পড়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে প্রাচীন মূর্তি। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম।
গ্রামের ভিতর মিউজিয়ম!
শুনতে আশ্চর্য লাগলেও সহজে উত্তর মেলে না, বীরভূমের মুরারই থানার পাইকর গ্রামে কে, কবে এই মিউজিয়ম গড়ে তুলেছিল।
কিন্তু গ্রামের সেই মিউজিয়মই পাইকর গ্রামের অনেক অজানা ইতিহাসের সাক্ষ্য দীর্ঘদিন থেকে বহন করে চলেছে। যা আজকের দিনের পাইকরবাসীর কাছে অহঙ্কারের বিষয়। উপযুক্ত সংরক্ষণের অভাবে সেই ইতিহাসের স্মৃতি সৌধই এখন অবক্ষয়ের মুখে।
ইতিহাস যেন এ এলাকার পথে-প্রান্তরে। পাইকর গ্রামের সঙ্গে ইতিহাসের যোগ সূত্র দেখে অনেকেই পাইকর গ্রামের আদিনাম প্রাচীকোট ছিল বলে মনে করেন। মুরারই কবি নজরুল কলেজের ইতিহাসের শিক্ষক অর্নিবাণ জ্যোতি সিংহ বলেন, ‘‘পাইকর গ্রামে রাজা বিজয় সেনের পারিষদ পাহিদত্তর নাম থেকে পাইকর গ্রামের নাম হতে পারে বলে অনেকে মনে করেন।’’ স্থানীয় বাসিন্দা লেখক দীনবন্ধু দাসের কথায় অবশ্য, ‘‘পাইকর গ্রামে কোটেরডাঙা মাঠ এখনও আছে। সেই কোট অর্থাৎ দুর্গ পাইকদের জন্য দুর্গ পাইকর গ্রামে ছিল। সেইজন্য পাইকর গ্রামের নাম প্রাচীকোট ছিল বলে মনে করেন কেউ কেউ।’’
ঢালাই রাস্তা ধরে মুরারই ২ ব্লকের প্রশাসনিক কার্যালয় ভবন যাওয়ার সময় লক্ষ্য করা যায়, রাস্তার ধারে বড় আকারের প্রায় আড়াই ফুট লম্বা এবং দেড় ফুট উচ্চতার কালো পাথরের একটি ষাঁড়ের মূর্তি। গ্রামবাসীরা সেটিকে লোহার গ্রিল দিয়ে ঘিরে রেখেছেন। ষাঁড় এক অর্থে শিবের বাহন। সেই জন্য এলাকার নাম বুড়ো শিবতলা। অনেকে আবার গাম্ভীরা তলাও বলেন।
বিনয় ঘোষ তাঁর ‘পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি’ বইতে পাইকর নিয়ে লিখেছিলেন, “এত বিচিত্র মূর্তির একত্র সমাবেশ একটি গ্রাম্য দেবমন্দিরে আর কোথাও দেখিনি।’’ আসলে, এই বুড়ো শিবতলার শিব মন্দিরটাই আসলে পাইকরের কাছে মিউজিয়ম। মন্দিরের ভিতরে ঢুকলেই মালুম হয় কেন মিউজিয়ম। মন্দিরের ভিতর ঢুকলে দেখা যায়, প্রায় তিন ফুট উচ্চতার সিমেন্টের বেদীর উপর পাঁচ মিটার অংশ জুড়ে পঞ্চাশটির বেশি ছোট-বড় মাপের শিলা মূর্তি সার সার করে দাঁড় করানো আছে। কালো পাথরের সেই শিলামূর্তিগুলির মধ্যে রয়েছে বেশির ভাগই ২–৩ ফুট উচ্চতার বাসুদেব মূর্তি। আর রয়েছে মনসা, গণেশ, শীতলা, সূর্য, হনুমান, রামচন্দ্র, বিষ্ণু অবতার নৃসিংহ ও নানান রকমের দেবী শক্তির মূর্তি। খুব ছোট তিন চার ইঞ্চি মূর্তি থেকে তিন চার ফুট পর্যন্ত বড় বড় মূর্তিগুলিকে কবে এই ভাবে একত্রিত করে একটি গ্রামের মন্দিরে রেখে দিয়েছেন তার ইতিহাসও অজানা বুড়ো শিবমন্দিরের সেবাইত সুদেব চট্টোপাধ্যায়, চঞ্চল চট্টোপাধ্যায়দের।
ফি বছর শ্রীপঞ্চমী তিথিতে বুড়ো শিবতলার মন্দির ঘিরে পাইকরে প্রাচীন উৎসব ‘ভক্তমারা উৎসব’ হয়। এলাকায় অবশ্য ভক্তমার উৎসব বলা হলেও বাণব্রতের উৎসব বলা হয়। তবে উৎসব উপলক্ষে জাঁকজকম ভাবে পুজো হয় বুড়ো শিবের ও ক্ষ্যাপাকালির। বুড়োশিবতলার মন্দিরকে যখন বীরভূম গেজিটিয়ারও মিউজিয়াম বলে উল্লেখ করছে, তখন এই গ্রামের হাই স্কুল লাগোয়া নারায়ণ চত্ত্বর আজও অবহেলিত। গ্রামের ষষ্টিতলায় প্রাচীন বট গাছের তলায় খোলা আকাশের নীচে বেদীতে প্রচুর ভাঙা মূর্তি ও বেশ কয়েকটি দেবী মূর্তি অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে রয়েছে। অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে চেদি রাজ রাজা কর্ণ-র বিজয় স্তম্ভ।
গ্রামের সাংস্কৃতিক কর্মী রুপনাথ রায় এবং লেখক দীনবন্ধু দাসদের দাবি, ‘‘প্রশাসনের উদ্যোগের অভাব তো রয়েইছে। তবে এই ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক নির্দশনকে সংরক্ষিত করার ব্যবস্থা প্রশাসনের করা উচিত ছিল।’’ নারায়ণ চত্ত্বর এলাকায় রয়েছে নরসিংহ মূর্তিও। বীরভূমের গেজিটিয়ারেও এই জায়গার উল্লেখ যেমন আছে, তেমনি রোদ ও বৃষ্টিতে শিলালিপির ঔজ্জ্বল্য নষ্ট হওয়ার কথা বলা হয়েছে। গেজিটিয়ার থেকে জানা যাচ্ছে, পাইকর গ্রামে রাজা কর্ণদেবের এবং বিজয়সেনের আমলের দুটি শিলালিপি পাইকর গ্রামে রয়েছে। এবং শিলালিপির অক্ষরগুলি উত্তর-পূর্ব ভারতের প্রচলিত আদি বাংলা অক্ষর। পাইকরের আজান শহিদ সমাধি ক্ষেত্রটিও এলাকা বাসীর কাছে পবিত্র স্থান। এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইতিহাসের সাক্ষী সংরক্ষণ নিয়েই নানা দাবি এলাকায়। তাঁরা চান সঠিক মূল্যায়ণ এবং উপযুক্ত সংরক্ষণ।
সিউড়ি বিদ্যাসাগর কলেজের ইতিহাসের শিক্ষক পার্থশঙ্খ মজুমদার বলেন, “পাইকর গ্রামে চেদি রাজ কর্ণদেব এবং রাঢ এলাকার সেন বংশের রাজা বিজয় সেনের ইতিহাসের অনেক প্রমাণ রয়েছে। সেই সমস্ত ইতিহাস সংরক্ষনের জন্য গ্রামবাসীরও অনেক দায়িত্ব আছে। তাঁদেরকেও প্রশাসনের ভরসায় না থেকে এগিয়ে আসতে হবে।’’
মুরারই ২ ব্লকের বিডিও শমিত সরকার বলেন, ‘‘সেই অর্থে সংরক্ষণের বিষয়ে তেমন কোনও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। প্রত্নতাত্ত্বিক দফতর থেকে যদি আগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে ব্লক প্রশাসন থেকে সব রকম সাহায্য করতে রাজি আছি।’’