এই সেই ধাবা। মঙ্গলবার জয়দেব মোড়ের তোলা নিজস্ব চিত্র।
সন্ধে রাত। বৃষ্টি পড়ছে। হাইওয়ের ধারে জয়দেব মোড়ের ধাবাগুলোয় টিমটিমে আলো। ধাবার সামনে সার সার দাঁড়িয়ে ট্রাক। একটা ধাবার সামনে কয়েকটা ট্যাঙ্কার। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, আবছা অন্ধকারে সেই খালি ট্যাঙ্কারগুলো ভরে দিচ্ছে সরু একটা লিকলিকে পাইপ! তেল আসছে ধাবা ছাড়িয়ে পিছন আগাছা-বর্ষার জলে ডোবা মাঠ দিয়ে অদূরে চলে যাওয়া ইন্ডিয়ান অয়েলের পাইপলাইন থেকে চোরা-পাইপে! দুবরাজপুর থানায় ইন্ডিয়ান অয়েলের অভিযোগ বলছে, ট্যাঙ্কার ট্যাঙ্কার তেল গায়েব হয়ে গিয়েছে এই ক’মাসে তাদের পাইপলাইন থেকে!
গত সাত-আট মাস ধরে পানাগড়-দুবরাজপুর ১৪ নম্বর সড়ক ধরে এভাবেই চোরাই তেল ছড়িয়ে পড়ছিল ওই হোটেল চক্রের হাত ধরে রাজ্যে, ভিন রাজ্যে! মঙ্গলবার জানাজানি হতেই নানা জল্পনা উস্কে দিয়েছে ওই ধাবা-সংলগ্ন পড়শি এক ধাবা থেকে অন্য ধাবায়। দুপুর গড়াতেই কালো মাথার ভিড় বাড়তে থাকে ধাবার সামনে। ইন্ডিয়ান অয়েলের কর্মীদের দেখে ভিড়ের মধ্যেই নানা প্রশ্ন। কেউ কেউ ভিতরে উঁকি দিতে চান। কেউ নজর এড়িয়ে নেমে পড়তে চান মাঠের জলা জমিতে। প্রসঙ্গত, একই লাইনে তেল চুরির ঘটনা আগেও ঘটেছে। বছরখানেক আগেই খয়রাশোলের লোকপুরের মাঠে তেল চুরির একটি চক্র ধরা পড়েছিল। এ ভাবে ঝাড়খণ্ড এলাকাতেও একাধিক বার তেল লুঠ হয়েছে বলেও অভিযোগ।
কারবার যে বেশ কিছু দিন থেকেই চলছে ভিড়ের মধ্যে কান পাততেই জানা গেল, খেতজমি দিয়ে যাওয়া পাইপলাইন দিয়েই হলদিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল বিহারের বারাউনিতে যায়। তারই একটি পাইপে ফুটো করে সেখানে নতুন পাইপ যোগ করে দীর্ঘ দিন ধরে সেই তেল কেনাবেচা করছিলেন জয়দেব মোড়ের ওই হোটেল ব্যবসায়ী। সেটাই বামাল ধরা পড়েছে। ইন্ডিয়ান অয়েল কর্তৃপক্ষের অভিযোগের ভিত্তিতে দুবরাজপুর থানা ওই হোটেল মালিকের ছেলে গোলাপ খানকে গ্রেফতার করেছে। হোটেল মালিক আরাফত খান পলাতক।
ইন্ডিয়ান ওয়েলের আধিকারিক, ইঞ্জিনিয়ার ও বিভিন্ন যন্ত্রপাতি লাগানো গাড়ি এলাকাকে ঘিরে মানুষের উত্তেজনা শেষ নেই সন্ধে গড়িয়ে রাতেও। জানা গেল, রবিবার সকাল থেকেই ইন্ডিয়ান অয়েলের গাড়ি ঘুরছিল এলাকায়। স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, ‘‘সংস্থার কর্মীরা এসে ধান জমির মধ্যে খোঁড়াখুড়ি শুরু করে ছিল। কিন্তু তখনও জানতাম না যে আমাদের অবাক হওয়ার অনেক বাকি!’’ নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, রাতারাতি যেন ফুঁলে ফেঁপে উঠছিল গাঁড়া গ্রামের পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা হোটেল ব্যবসায়ী আরাফতের পরিবার। রাতবিরেতে তেল ট্যাঙ্কারের দাঁড়িয়ে থাকা। হঠাৎ হঠাৎ বড় অঙ্কের টাকা পয়সার লেনদেন।
এলাকার মানুষ বলছেন, ওই ব্যবসায়ী, তাঁর ছেলে ছাড়াও নিয়মিত এলাকার এবং বাইরের কিছু লোকের নিয়মিত যাতায়াত সন্দেহ বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু শিকড় এতটা গভীরে সেটা সত্যিই বোঝা যায়নি। যদিও ব্যাপারগুলি নজরে আসাতে শুরু করছে প্রায় সাত আটমাস আগে থেকে। সম্প্রতি খুব বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে দুবরাজপুর থানা এলাকায় একটি জমি কেনা এবং গাঁড়া গ্রামের বাড়ির সামনে প্রচুর দামি ইট নামানোয় চোখে পড়েছিল এলাকাবাসীর। প্রশ্ন উঠছিল, টাকার উৎস্য কোথা থেকে? উত্তর এ দিন মিলেছে!
মূল পাইপ লাইন থেকে তেল চুরির জন্য জমির তলায় এভাবে পাইপ কিভাবে বসালো সেটা নিয়েও স্থানীয়দের জল্পনার শেষ নাই!
কিছু বাসিন্দা জানাচ্ছেন, নিজে যে জমিটি চাষ করেন আরাফত সেটা ছাড়াও টাকার শর্তে এলাকার বেশ কয়েকজন চাষির কাছে এ বার সরষে ও তিল চাষের জন্য জমি নিয়েছিলেন। সেই সময়েই এ কাজ হয়েছে রাতারাতি। তখন একসঙ্গে ট্রাক্টর ও মাটিকাটার যন্ত্র দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন অনেকে। পুলিশের একাংশ ও বাসিন্দারা বলছেন, কোটি কোটি টাকার তেল চুরি হয়েছে বলে আপাতত জানা গিয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, আরেকটি বিষয় নিয়েও। রাস্তার ধারে হোটেল বা ধাবায় নিত্য পুলিশের যাতায়াত। অথচ পুলিশ এত দিন ধরে ঘটে চলা অপরাধের বিন্দুবিসর্গ টের পেল না কেন? অন্য দিকে মূল যে পাইপের সঙ্গে রীতিমতো ঝালাই করে চুরির জন্য পাইপ লাগানো হয়েছিল সেটা করতে হলে জানা জরুরি পাইপলাইন দিয়ে তেল যাওয়ার হালহকিকত। কীভাবেই বা এই তথ্য অপরাধীদের কাছে পৌঁছল সেই তথ্য— প্রশ্ন উঠছে সে নিয়েও। সংস্থার তরফে এই নিয়ে কোনও বক্তব্য মেলেনি। পুলিশও মুখ খুলতে চায়নি।
তবে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, এক সময় জয়দেব মোড় এলাকায় ব্যবসায়ীদের সুরক্ষায় পুলিশের গড়ে দেওয়া আর্জি পার্টিতে ছিলেন আরাফতও। কিন্তু বর্ধমান থেকে বিভিন্ন জিনিস চুরি যাওয়া এবং ওই রাস্তায় যাতায়াতকারীদের জিনিসপত্র চুরি যাওয়া দেখে পুলিশ বোঝে রক্ষকই ভক্ষক। তুলে দেওয়া হয় আর্জি পার্টি। জয়দেব মোড়ে পাশের একটি পেট্রোল পাম্পে পরপর তিনবার চুরির ঘটনায় ধরা পড়ে আর্জি পার্টির দুই সদস্য। এ বার তেল চুরিতে আবার সেই আর্জি পার্টির সদস্যের নাম জড়িয়ে গেল। এলাকাবাসীর দাবি ঘটনার তদন্ত হলে অনেক রাঘব বোয়াল ধরা পড়বে।