বাড়িতে শোকার্ত রেশমা। বৃহস্পতিবার। নিজস্ব চিত্র
রেল কর্তৃপক্ষের দাবি, ‘শ্রমিক স্পেশাল’ ট্রেনে মৃত শিশুর অভিভাবকেরা তাঁদের কোনও অভিযোগ নেই বলে লিখিত জানিয়েছেন। তবে বৃহস্পতিবার পুরুলিয়ার জয়পুরের বালি গ্রামে ওই পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের বাড়িতে গিয়ে পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করলেন, ‘ভুল বুঝিয়ে’ মৃত শিশুর বাবার থেকে একটি বয়ানে সই আদায় করেছে রেল। একই অভিযোগে তিনি রেলমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন বলে এ দিন দাবি করেছেন বাঘমুণ্ডির কংগ্রেস বিধায়ক নেপাল মাহাতো। পুরুলিয়ার বিজেপি সাংসদ জ্যোতির্ময় সিং মাহাতো বলেন, ‘‘যে কোনও মৃত্যুর ঘটনা দুঃখজনক। আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি। চাইব, তদন্তে প্রকৃত সত্য উঠে আসুক।’’ তিন সদস্যের উচ্চ পর্যারের কমিটি গঠন করে ইতিমধ্যেই ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে বলে দক্ষিণ-পূর্ব রেল সূত্রে জানা গিয়েছে।
কেরল থেকে নিউ জলপাইগুড়িগামী একটি ‘শ্রমিক স্পেশাল’ ট্রেন বুধবার দুপুরে খড়্গপুর পৌঁছয়। সেই ট্রেনে ছিলেন সপরিবার ছিলেন কেরলের কাসারগোড়ের ব্যাগ কারখানার শ্রমিক পুরুলিয়ার দিলদার আনসারি। তিনি দাবি করেন, ১৮ দিনের শিশুকন্যা রাবিয়া ট্রেনে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। রেলের ‘হেল্পলাইন’-এ ফোন করে কোনও সাহায্য মেলেনি। স্টেশনে ট্রেন দাঁড়ালে পুলিশকে বলেও কাজ হয়নি। খড়্গপুরে চিকিৎসক পরীক্ষা করে জানান, ওই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তার পরেই শোরগোল পড়ে যায়। বুধবার রাতে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সঞ্জয় ঘোষ দাবি করেন, রেলের বিরুদ্ধে তাঁদের কোনও অভিযোগ নেই বলে জানিয়েছেন মৃত শিশুর বাবা।
খড়্গপুরের ময়না-তদন্তের পরে, পুরুলিয়া জেলা প্রশাসনের পাঠানো গাড়িতে বুধবার গভীর রাতে শিশুর দেহ বাড়িতে পৌঁছয়। বৃহস্পতিবার সকালে তাকে সমাহিত করা হয়েছে। বালি গ্রামে ওই পরিবারের সঙ্গে এ দিন দেখা করতে যান বিডিও (জয়পুর) বিশ্বজিৎ দাস। তিনি জানান, ‘সমব্যথী’ প্রকল্পে শিশুর সৎকারের জন্য পরিবারটিকে সহায়তা করা হয়েছে। তা ছাড়া, কিছু খাবার দেওয়া হয়েছে তাঁদের। দিলদারদের বাড়িতে গিয়েছিলেন পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি তৃণমূলের সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি কথা বলেন দিলদারের স্ত্রী রেশমা ও ভাই সরফরাজের সঙ্গে। পরে সুজয়বাবু দাবি করেন, ‘‘অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে ওড়িশা ঢোকার সময়ে পরিবারটি রেলের হেল্পলাইনে ফোন করেছিল। তখন বলা হয়, নিজের রাজ্যে যোগাযোগ করতে। পরে সহায়তা দেওয়ার নামে ভুল বুঝিয়ে একটা বয়ানে সই করিয়ে নিয়েছে রেল। তাঁরা বিচার চাইতে আইনের দ্বারস্থ হবেন বলে জানিয়েছেন। আমরা তাঁদের পাশে থাকব।’’
এ দিন দিলদার বলেন, ‘‘রেলের লোকজন হিন্দিতে লেখা একটা কাগজে সই করেত বলে। আমাকে বোঝানো হয়, এতে কোনও ক্ষতি হবে না। খড়্গপুরে পুলিশ যে সাহায্য করেছে সেই কথাই লেখা আছে। বলা হয়েছিল, আরও সাহায্য মিলবে। কী লেখা আছে, সেটা পড়েও শোনায়নি। আমার মনের অবস্থা ঠিক ছিল না। সই করে দিয়েছিলাম।’’ তাঁর দাবি, সই করার সময়ে কাগজটির ছবি তুলে রেখেছিলেন। পরে জানতে পারেন, তাতে অন্য কথা লেখা রয়েছে। দিলদার বলেন, ‘‘খড়্গপুর আসার পরে পুলিশ আর প্রশাসন সাহায্য করেছে। আমাদের অভিযোগ রেলমন্ত্রীর (পীযূষ গয়াল) বিরুদ্ধে। পরিযায়ী শ্রমিক পরিবারের বাচ্চার প্রাণের দামটুকুও কি নেই?’’
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অবশ্য ওই পরিবারের তরফে এই ব্যাপারে কোথাও কোনও লিখিত অভিযোগ জানানো হয়নি। দিলদারের ভাই সরফরাজও কেরলের ওই ব্যাগ কারখানায় কাজ করেন। তিনিও ওই ট্রেনেই ছিলেন। সরফরাজ বলেন, ‘‘আমরা যখন খড়গপুর থেকে পুরুলিয়া ফেরার গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, তখন রেলের এক জন দাদাকে ওই কাগজে সই করতে বলে। আমি বা দাদা, কেউই হিন্দি জানি না। বলেছিল, কাগজটা রেলমন্ত্রীর কাছে যাবে। সাহায্য করা হবে। পরে শুনলাম, ওতে লেখা ছিল আমাদের রেলের বিরুদ্ধে নাকি কোনও অভিযোগ নেই।’’ তাঁর দাবি, ‘‘মোবাইল থেকে হেল্পলাইনে ফোন করেছিলাম। সেটা কল-রেকর্ড দেখলেই জানা যাবে। স্টেশনে যে পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়েছিলাম, সেটাও সিসিটিভিতে ধরা পড়ার কথা। আমরা চাই, তদন্ত হোক।’’
দক্ষিণ-পূর্ব রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক সঞ্জয় ঘোষ বৃহস্পতিবার বলেন, ‘‘এই ঘটনা নিয়ে কেউ আমাদের কাছে কোনও লিখিত অভিযোগ করেননি। তবে একটা অভিযোগ উঠেছে। তিন সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গড়া হয়েছে। তদন্তও শুরু হয়েছে। তবে, ঘটনাটি ইস্ট-কোস্ট জ়োনের।’’ ভুল বুঝিয়ে বয়ানে সই করিয়ে নেওয়ার দাবি প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘যতটুকু জানি, কারও বিরুদ্ধে ওই শিশুর বাবার কোনও অভিযোগ নেই বলে লেখা রয়েছে। তবে এই ঘটনাটিও খতিয়ে দেখা হবে।’