এ ভাবে উড়তেই থাকে ধুলো। মহম্মদবাজারের পাঁচামিতে। নিজস্ব চিত্র
সময়টা ২০১২-’১৩। ‘সিলিকোসিস’ রোগে আক্রান্ত মানুষের সঙ্কট কতটা তা, স্পষ্ট করে দিয়েছিল বীরভূমের পাথর শিল্পাঞ্চলের দুই শ্রমিকের মৃত্যু। এক জন মহম্মদবাজারের তালবাঁধের বছর পঁয়তাল্লিশের মিছু মুর্মু। অন্য জন ওই ব্লকেরই দেওয়ানগঞ্জের দেবু রাউত। উভয়ের পরিবার ৪ লক্ষ টাকা করে সরকারি ক্ষতিপূরণ পেয়েছে।
পাথর শিল্পাঞ্চলের কাজে যুক্ত শ্রমিকদের মারণ বক্ষরোগ সিলিকোসিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এটি মূলত পেশাগত রোগ। এটি এমন একটি রোগ, যার মূলে রয়েছে ‘ক্রিস্টালাইজ়ড সিলিকা’ বা স্ফোটিকাকৃতি বালি বা পাথরের কণা। যেখানে এমন কণা উড়ছে, দীর্ঘদিন সেই পরিবেশে কাজ করলে বালি, পাথরের কণা জমে জমে ফুসফুসের উপরি ভাগের মারাত্মক ক্ষতি হয়ে সিলিকোসিস রোগ হতে পারে। এই রোগের উপসর্গ বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, জ্বর, শেষ দিকে শরীর নীলাভ হয়ে যাওয়া। বীরভূমের পাঁচটি ব্লকে রমরমিয়ে চলছে পাথর শিল্প। এই কাজে যুক্ত হাজার হাজার শ্রমিক। কিন্তু, ওই দুই শ্রমিকের মৃত্যুর পরে বীরভূমে আর এক জনও সিলিকোসিসে আক্রান্ত হয়েছেন, এমন খবর জেলা স্বাস্থ্য দফতর বা প্রশাসনের কাছে নেই।
মঙ্গলবার উত্তর ২৪ পরগণার সন্দেশখালি ১ ব্লকের রাজবাড়ির সুন্দরীখালি গ্রামে সুবর্ণ গায়েন নামে বছর ষাটের এক ব্যক্তির সিলিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু এবং ওই এলাকার আরও কয়েক জন সিলিকোসিসে আক্রান্ত হওয়ার খবর প্রকাশ্যে আসায় এই নিয়ে নতুন করে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। মৃত ও আক্রান্ত ব্যক্তিরা সকলেই আসানসোল, জামুড়িয়া, কুলটি, রানিগঞ্জ এলাকায় পাথর খাদানে কাজ করেছেন। সেই সুবাদেই ওই মারণ রোগ থাবা গেড়েছে তাঁদের শরীরে।
সেই সূত্রেই প্রশ্ন উঠছে, বীরভূম জেলার পাথর শিল্পাঞ্চলে কর্মরত এবং ওই এলাকায় বাসবাসকারী মানুষজনের স্বাস্থ্য নিয়ে কতটা নিশ্চিন্তে থাকা যায়?
অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) প্রশান্ত অধিকারী বলছেন, ‘‘সেই জন্যই প্রশাসন ও দু’টি স্বাস্থ্য জেলার (বীরভূম, রামপুরহাট) উদ্যোগে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার শিবির হয়ে থাকে। তবে, নতুন করে কেউ আক্রান্ত হয়েছেন, এমন খবর নেই। সঙ্গে রয়েছে শ্রম দফতরও। এলাকায় কেউ এই রোগে আক্রান্ত কিনা জানতে, কিছুদিনের মধ্যেই একটা সমীক্ষা করতে চলেছে স্বাস্থ্য দফতর।’’
বীরভূম স্বাস্থ্য জেলার ডেপুটি সিএমওএইচ শকুন্তলা সরকার জানিয়েছেন, বীরভূমে সিলিকোসিস আক্রান্ত ব্লকের মধ্যে রয়েছে মহম্মদবাজার। মোট জন সংখ্যা ১ লক্ষ ৭৪ হাজার। কিন্তু পুরো এলাকা নয়, ব্লকের মাত্র পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা, যেখানে পাথর শিল্পাঞ্চাল রয়েছে, সেখানে কর্মরত শ্রমিক ও বসবাসকারী মানুষের ভয় বেশি। তিনি বলেন, ‘‘২০১৪ সাল থেকে ৭০টি শিবির করা হয়েছে। কেউ সিলিকোসিসে আক্রান্ত কিনা জানতে চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে এলাকার বাড়ি বাড়ি সমীক্ষা শুরু হবে।’’
এ রাজ্যে সিলিকোসিস আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করেন অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ অ্যাসোসিয়েশন অব ঝাড়খণ্ডের সাধারণ সম্পাদক সুমিতকুমার কর। তিনি জানান, সিলিকোসিস চিহ্নিতকরণ এবং নির্মূল করার
লক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারও একটি বোর্ড গঠন করেছে। কিন্তু তা যথেষ্ট সক্রিয় নয়।
পাথর শিল্পাঞ্চলের বাসিন্দাদের একাংশ বলছেন, বীরভূমের পাঁচটি ব্লকে থাকা পাথর শিল্পাঞ্চলে যত শ্রমিক কাজ করেন, তাঁদের বেশির ভাগই আদিবাসী। তাঁদের এমন অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা শ্বাসকষ্ট বা সিলিকোসিসের মতো উপসর্গযুক্ত রোগে দীর্ঘদিন ভুগছেন। ’১৪ সালের পর থেকে স্বাস্থ্য দফতর ১৭ জনকে সম্ভাব্য রোগী হিসাবে চিহ্নিতও করেছিল। তার মধ্যে এক জন মারা গিয়েছেন।