একমন: মায়ের কাছে শেখা। নিজস্ব চিত্র
শিশুকে মা বলছেন, দু’বার হাত তালি, একবার চুটকি বাজাও। বা কাগজের বল তৈরি করে একটা পাত্রের মধ্যে ছোড়ো, বা বিড়ালের কুকুর, কাকের ডাক ডেকে শোনাও। অঙ্গনওয়াড়ি পরিচালন দফতরের বলে দেওয়া পথে এমনই ছোট ছোট খেলাচ্ছলে কাজের মাধ্যমে, গল্প ও গান শুনিয়ে, ছবিতে রং ভরতে বলে প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষা দিচ্ছেন তাঁদের মায়েরাই।
অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের তিন থেকে ছয় বছর বয়সী খুদেদের জন্য ই-লার্নিং বা অনলাইনে পড়াশোনার নির্দেশ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠলেও লকডাউনের মধ্যে বাড়িতে শিশুদের একঘেয়েমি কাটাতে এটা সহায়ক ভূমিকা নিয়েছে বলে বলছেন, সিউড়ি ২, রাজনগর, দুবরাজপুরের অনেক মায়েরাই। জেলা সুসংহত শিশুবিকাশ প্রকল্প আধিকারিক সৌরিশ বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘মিশ্র সাড়া মিলেছে। প্রথম এক সপ্তাহে হয়তো সকলের কাছে পৌঁছনো সম্ভব হয় নি। কিন্তু যে ভাবে এগোচ্ছে, তাতে সামনের কয়েকটা দিনের মধ্যে ১০০ শতাংশ না হলেও অধিকাংশ শিশুকে এর সঙ্গে যুক্ত করা যাবে। তার জন্য মিলিত ভাবে সুপারভাইজার, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী ও সহায়িকারা আন্তরিক চেষ্টা করে যাচ্ছেন। মা দের কাছ থেকেও ভাল সাড়া পাচ্ছি।’’
অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে শিশুদের যে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কর্মসূচি চলে, লকডাউন তাতে বাধা তৈরি করেছে। পাশাপাশি এই অবস্থায় শিশুদের বাড়ির মধ্যে আটকে রাখাটাও অভিভাবকদের কাছে মস্ত চ্যালেঞ্জ। কেন্দ্রে না গিয়েও বাড়িতে বসে তিন থেকে ছয় বয়সী শিশুদের শিক্ষণ পদ্ধতি যাতে চলতে পারে, সেই জন্য রাজ্য সরকারের অঙ্গনওয়াড়ি পরিচালন দফতর থেকে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
প্রশাসন সূত্রে খবর, ১০ মে রাজ্যের সব ক’টি জেলার জেলাশাসকের কাছে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে রাজ্য।
দফতর সূত্রে খবর, ওই নির্দেশিকায় বলা হয়েছে, লকডাউনের ফলে সকলেই প্রায় ঘরবন্দি। তাই অভিভাবকদের জন্য বেশ কিছু অডিয়ো বার্তা, রঙিন ছবি-সহ কিছু নির্দেশিকা ও শিশুদের জন্য নানা ধরনের ছড়া, গান তৈরি করা হয়েছে। সেগুলি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের মাধ্যমে সেই নির্দেশ ওই সব শিশুর অভিভাবকদের মোবাইল ফোনে পৌঁছে দিতে হবে। পাশাপাশি প্রতি সপ্তাহে কোন শিশু কোন কর্মসূচি কী ভাবে পালন করল, তার ছবিও অভিভাবকদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে। পুরো বিষয়টি সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছেন সুপারভাইজাররা।
নির্দেশ আসার সঙ্গে সঙ্গে নানা প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল। কারণ প্রশাসনের তথ্যই বলছে, পাঁচ হাজারের বেশি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে তিন থেকে ছয় বয়সী শিশুর সংখ্যা ১ লক্ষ ৫৫ হাজারেরও বেশি। প্রত্যন্ত এলাকার বসবাসকারী সেই সব শিশুর অভিভাবকদের আদৌ স্মার্টফোন আছে কি না, থাকলেও ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে কি না সে সব প্রশ্ন ছিল। প্রশ্ন উঠেছিল, সব কর্মীদেরই কি স্মার্ট ফোন আছে? দ্বিতীয়ত, যাঁদের হাতে সমন্বয় সাধনের দায় জেলার অনুমোদিত ২১৩ জন সুপারভাইজার পদে আদতে কর্মী রয়েছেন মাত্র ৬৩ জন। তাহলে কী ভাবে কাজ হবে তা নিয়ে একটা উদ্বেগ ছিল।
দফতরের কর্মী সহায়িকা ও সুপারভাইজারদের কথায়, ‘‘সেটা অবশ্যই একটা চ্যালেঞ্জ ছিল। কিন্তু দফতরের নির্দেশ মেনে প্রতি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের আওতায় থাকা ওই বয়সী শিশুদের সংখ্যাটা সর্বোচ্চ ৩০ হতে পারে। কোথাও কোথাও সেটা সীমিত ১৫-র মধ্যে। তাই আন্তরিক ইচ্ছে থাকলে যে সব পরিবারে স্মার্টফোনের মাধ্যমে দফতরের বার্তা পৌঁছনো যায়নি, সেই পরিবারগুলিতে রোজ না হোক, দু-একদিন গিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে কী করতে হবে বোঝানোটা মোটেই খুব কঠিন নয়।’’ এছাড়া পাড়ার বা পড়শি কারও ফোন থাকলেও সেই সব ফোন নিয়ে প্রতিটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে অনুয়ায়ী একটি করে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হয়েছে। সেখানে দফতর থেকে পাঠানো নির্দেশিকায় (অডিয়ো) পাঠালে অভিভাবকদের বোঝার সমস্যা নেই।
কিন্তু তারপরও সুপারভাইজারদের নামমাত্র সংখ্যা, কর্মীদের একাংশের সদিচ্ছার অভাব, একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের আওতায় থাকা নির্দিষ্ট বয়সী শিশুদের অভিভাবকদের (বিশেষ করে আদিবাসী এলাকায়) কাছে স্মার্ট ফোন না থাকা দফতরের ইচ্ছে ফলপ্রসূ হওয়ার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দফতরের এক কর্তা বলছেন, ‘‘স্কুল গুলিতে অনলাইন ক্লাসের সুবিধাও কি সব পড়ুয়া পেয়েছে? কেন্দ্রগুলি বন্ধ থাকায় একেবারেই কিছু না হওয়ার থেকে কিছু শিশুকে তো প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচিতে আনা যাচ্ছে। এটাকে ইতিবাচক দিক হিসেবেই দেখা উচিত।’’