বর্ধমানের বিবেকানন্দ কলেজমোড়ের বাজারে ক্ষুদি রায়। ছবি: উদিত সিংহ
বিপর্যয়ের পরে দুই সন্তানকে বড় করতে শুরু করেছিলেন আনাজের ব্যবসা। নিজে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এলাকার অন্য মহিলাদেরও ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বাঁকুড়ার ইন্দাসের বহলালপুরের ক্ষুদি রায়। তাঁদের বর্ধমান শহরে নিয়ে গিয়ে ব্যবসা করে স্বনির্ভরতার পথ দেখিয়েছেন। এ ভাবে গ্রামের বহু ‘দিন আনা, দিন খাওয়া’ মানুষের কাছে তিনিই হয়ে উঠেছেন ‘দুর্গতিনাশিনি’।
বছর চুয়ান্নর ক্ষুদির জীবন-যুদ্ধ অবশ্য এতটা সহজ ছিল না। তিনি জানান, তখন তিনি চোদ্দো কি পনেরো। বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু এক ছেলে ও এক মেয়ে ছোট থাকাকালীনই তাঁর স্বামী নিরুদ্দেশ হন। তিনি বলেন, ‘‘বাড়িতে বয়স্ক বাবা-মা। তাঁদেরই কে দেখে, ঠিক নেই। জমিজমাও নেই যে চাষ করে খাব। সংসার টানতে লোকের বাড়ির পরিচারিকার কাজ নিই। কিন্তু সামান্য মজুরিতে সংসার চলে না। পরিচারিকার কাজের পাশাপাশি, গ্রামের হাটেই আনাজ বিক্রি শুরু করি। গ্রাম থেকে বর্ধমান শহরে বাস চলাচল শুরু হওয়ায় কয়েক জনের পরামর্শে আনাজ নিয়ে গিয়ে বর্ধমানের বিবেকানন্দ কলেজমোড়ে বিক্রি শুরু করলাম। ভালই দাম পাচ্ছিলাম। স্বাচ্ছন্দ্য ফিরতে থাকে সংসারে।’’ তিনি জানান, ছেলেমেয়ে দু’জনকেই পড়িয়েছেন। ছেলে এখন রং মিস্ত্রি। মেয়েরও বিয়ে হয়েছে।
তাঁর মতোই এলাকার যে সব মহিলার জীবন টলোমলো হয়েছে, তাঁদের পাশেও দাঁড়ান ক্ষুদি। বহু দুঃস্থ মহিলাকে ব্যবসা করে স্বনির্ভরতার পথ দেখিয়েছেন তিনি। এমনই এক জন ইন্দাসের চাঁদ গ্রামের বিধবা ঝর্না মাঝি। তিনি বলেন, ‘‘স্বামীকে হারিয়ে যখন সংসার কী ভাবে চলবে ভেবে পাচ্ছিলাম না, তখন ক্ষুদিদি বর্ধমানে নিয়ে গিয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে আনাজ বিক্রির সুযোগ করে দেন।’’ ক্ষুদির দেখানো পথে প্রতিষ্ঠিত ইন্দাসের ঈশ্বরপুরের সাগরি মালিক বলেন, ‘‘বর্ধমানে মাছের ব্যবসা করি। সংসারের হাল ধরতে পেরেছি ক্ষুদিদির দেখানো পথেই। কত মেয়েকে যে উনি স্বনির্ভর করেছেন, তার ঠিক নেই।’’
ইন্দাসের কাছের শহর বর্ধমান। চিকিৎসার জন্যও ভরসা ওই শহরই। সে জন্য গ্রামের কারও বর্ধমানে গিয়ে চিকিৎসা করানোর প্রয়োজন হলেই ক্ষুদির খোঁজ পড়ে। তিনিও কোন রোগের জন্য কোন ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, সব ব্যবস্থা করেন। নিজেও রোগীদের নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখান। বহলালপুর গ্রামের নবকুমার রায় বলেন, ‘‘গ্রামের কোনও গরিব মানুষ বর্ধমানে চিকিৎসার জন্য গেলে ক্ষুদি খুবই সাহায্য করেন। ডাক্তারের কাছে নাম লেখানো থেকে কোন বাসে যেতে হবে, ফিরতে হবে— সব উনি ঠিক করে দেন।’’ ওই গ্রামের অজিত রায় বলেন, ‘‘কেউ বর্ধমানের হাসপাতালে ভর্তি থাকলে তাঁর খবর আনা, দেখতে যাওয়া, প্রয়োজনে নিজের সীমিত রোজগার থেকে অর্থ সাহায্যও পর্যন্ত করেন। ওঁর মন অনেক বড়।’’