এক রেলকর্মীর মৃত্যুর জেরে বিষ্ণুপুর স্টেশনে ভাঙচুর চালাল জনতা। প্রহৃত অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন ম্যানেজার রাজু সাউ (ইনসেটে)—শুভ্র মিত্র
ট্রেনের ধাক্কায় এক সিগন্যালম্যানের মৃত্যুকে ঘিরে ধুন্ধুমার বাধল বিষ্ণুপুর স্টেশনে। উত্তেজিত জনতা রেলকর্মীদের মারধর করে স্টেশনে ভাঙচুর চালাল। সেখানেই শেষ নয়। পরে আশপাশের স্টেশন থেকে রেলের সিগন্যালম্যানরা জড়ো হয়ে স্টেশন ম্যানেজার-সহ আধিকারিকদেরও মারধর করে বলে অভিযোগ। বুধবারের ওই ঘটনার জেরে প্রায় আধ ঘণ্টা বিষ্ণুপুর স্টেশন কার্যত অসুরক্ষিত অবস্থায় পরে থাকল। পরিস্থিতি বিচার করে বিষ্ণুপুরের আগে পিয়ারডোবা স্টেশনে শিরোমণি প্যাসেঞ্জার আধঘণ্টারও বেশি সময় ধরে থামিয়ে রাখা হয়।
রেলসূত্রে খবর, বুধবার রাত ৮টা ৫০ নাগাদ ময়নাপুর থেকে বাঁকুড়ামুখী একটি লোকাল ট্রেন বিষ্ণুপুর স্টেশনে ঢোকার আগে রেলগেটে সুশান্ত মণ্ডল (৪২) নামে এক সিগন্যালম্যানকে ধাক্কা মারে। তালড্যাংরা থানার সাবড়াকোন গ্রামে তাঁর বাড়ি। গুরুতর জখম অবস্থায় ওই ব্যক্তি সেখানে পড়ে ছটফট করতে থাকেন। কিন্তু ঘটনাটি প্রথমে কোনও রেলকর্মীর নজরে আসেনি। পরে নজরে এলে তাঁরা ওই জখম রেলকর্মীকে উদ্ধার করতে যান। অভিযোগ, সেই সময় বন্ধ রেলগেটে আটকে থাকা লোকজন ওই রেলকর্মীদের উপর চড়াও হয়ে মারধর করেন। তাঁদের অভিযোগ, জখম সহকর্মীকে উদ্ধারে ওই রেলকর্মীরা দেরি করেছেন। রেলের আরও অভিযোগ, খবর পেয়ে বিষ্ণুপুর স্টেশন থেকে অন্য রেলকর্মীরা স্ট্রেচার নিয়ে জখম রেলকর্মীকে উদ্ধার করতে গেলে তাঁদের ধরেও মারধর করা হয়।
যদিও ওই রেলগেট লাগোয়া এলাকার বাসিন্দাদের পাল্টা অভিযোগ, বিষ্ণুপুর স্টেশন কর্তৃপক্ষ ও জিআরপি কর্মীদের তাঁরা ওই রেলকর্মীকে উদ্ধারের জন্য বারবার অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা উদ্ধারে গড়িমসি করেন। তখন ওই বাসিন্দারাই রিকশায় ওই রেলকর্মীকে বিষ্ণুপুর হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু ততক্ষণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
এরপরেই উত্তেজিত জনতা স্টেশনে হামলা চালায়। অভিযোগ, তাঁরা সংখ্যায় প্রায় শদেড়েক ছিলেন। রেললাইন থেকে তারা পাথর তুলে প্লাটর্ফমে ছুড়তে থাকে। মালপত্রের বুর্কিং কাউন্টার, প্রথম শ্রেণির বিশ্রামাগার, সাধারণ যাত্রীদের বসার জায়গা, নোটিসবোর্ডের কাচ লাঠি দিয়ে ভাঙচুর চালানো হয়। সেই সময়ে প্লাটফর্মে ছিলেন স্টেশন ম্যানেজার অঞ্জনকুমার মণ্ডল, দুই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার রাজু সাউ ও অর্জুন অধিকারী। অঞ্জনবাবুর দাবি, ‘‘মারমুখী জনতাকে দেখে আমরা ভয়ে অফিসে থেকে বেরিয়ে যাই। আধ ঘণ্টা ধরে তাণ্ডব চলে। আমি স্টেশনের একটি কাঁঠালগাছের নীচে আধো অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে বিষ্ণুপুরের এসডিপিও-কে ফোন করে সাহায্য চাই। তিনি বাহিনী নিয়ে আসতেই হামলাকারীরা পালায়।’’
পুলিশ দেখে সাহস পেয়ে রেলকর্মীরা অফিসে ফেরেন। কিন্তু তাঁরা তখনও জানতেন না, আরও একটি হামলা আসতে চলেছে। বিষ্ণুপুরের রেলকর্মীদের অভিযোগ, তাঁদের গাফিলতিতেই সুশান্তবাবুর মৃত্যু হয়েছে বলে গুজব রটে যায়। আশপাশের বিভিন্ন স্টেশনের সিগন্যালম্যানরা সেই গুজব ঠিক কি বেঠিক তা যাচাই না করেই বিষ্ণুপুর স্টেশনে এসে হামলা চালায়। অঞ্জনবাবুর অভিযোগ, ‘‘সিগন্যালম্যানরা অন্তত জনা কুড়ি ছিল। তারা আমাদের অফিসের ভিতরে ঢুকেই আমাকে, দুই অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারকে মারধর করে পোশাক ছিঁড়ে দেয়। ওই রেলকর্মী মোটেই আমাদের গাফিলতিতে মারা যাননি। কিন্তু তাঁরা আমাদের কথা শুনতেই চাননি।’’
বৃহস্পতিবার আদ্রার এডিআরএম হরিশচন্দ্র-সহ রেলের কর্তারা বিষ্ণুপুর স্টেশন পরিদর্শনে আসেন। রেল সূত্রে জানা যায়, তাঁরা বিভাগীয় তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন। তবে এ দিন পর্যন্ত রেল এফআইআর করেনি।
কেন? রেলের এক কর্তা বলেন, ‘‘হামলার ঘটনায় রেলের কিছু কর্মী যুক্ত বলে অভিযোগ উঠেছে। তাই প্রাথমিক পর্বে পুলিশে এফআইআর করা হচ্ছে না। বিভাগীয় তদন্ত করে প্রয়োজনে এফআইআর করার কথা ভাবা হবে।’’ রেলের আদ্রা বিভাগের সিনিয়র ডিসিএম ভাস্কর এ দিন বলেন, ‘‘এডিআরএম-সহ রেলের একটি দল বিষ্ণুপুরে গিয়ে পুরো পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে আসেন। বিভাগীয় তদন্তও শুরু হয়েছে। কী পাওয়া যায়, না পাওয়া যায়, তা খতিয়ে দেখে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’