Society

কালীও কালো, তবু কালো মেয়ে ব্রাত্য কেন?

গায়ের রং নিয়ে আমার মতো সব শ্যামলা মেয়েদেরই হীনম্মন্যতায় ভুগতে বাধ্য করায় সমাজ। ছোটবেলায় গায়ের রঙের কারণে কোনও কোনও শিক্ষিকার কাছে অবহেলা পেয়েছি।

Advertisement

অর্পিতা দাস

জমাদার গ্রাম, বড়জোড়া শেষ আপডেট: ২৪ অক্টোবর ২০২২ ০৯:৫৭
Share:

অঙ্কন: কুণাল বর্মন।

ছোটবেলা থেকেই গায়ের কালো রঙের জন্য খোঁটা শুনে শুনে বড় হওয়া। এক চাষিবাসি পরিবারের মেয়ের গণিতে স্নাতকোত্তরে ভাল ফল, বিএড-এ ভাল ফল, মঞ্চে আবৃত্তি, বিতর্কসভায় যোগ দেওয়া, পত্রপত্রিকায় লেখার ক্ষমতা রয়েছে। তবুও সে সব গুণ সমাজের কাছে বিবেচ্য হয় না। যে গ্রাম থেকে কেউ কখনও এমএসসি করেনি, সেখান থেকে একটা মেয়ের গণিতে এমএসসি ঢাকা পড়ে যায় শুধু তাঁর গায়ের রং কালো বলে!

Advertisement

গায়ের রং নিয়ে আমার মতো সব শ্যামলা মেয়েদেরই হীনম্মন্যতায় ভুগতে বাধ্য করায় সমাজ। ছোটবেলায় গায়ের রঙের কারণে কোনও কোনও শিক্ষিকার কাছে অবহেলা পেয়েছি। কোনও নতুন জামা পরে মায়ের কাছে গিয়ে কেমন লাগছে জানতে চাইলে, উত্তর পেয়েছি ‘ফর্সা হলে ভাল মানাত’। মাকে বোঝাতে পেরেছি, ফর্সা যখন নই, তখন কেমন লাগছে সেটাই বল।

উচ্চ মাধ্যমিকের সময় এক অঙ্কের শিক্ষকের কাছে জানতে পারি, থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের কষ্টের কথা। তিনি থ্যালাসেমিয়া নিয়ে সচেতনতার কাজ করেন। তখন থেকেই বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে শতাধিক থ্যালাসেমিয়া সচেতনতার শিবির করছি। ওই শিশুদের জন্য রক্তদানে এগিয়ে আসতে বাসিন্দাদের বোঝাই। নিজেও রক্তদান করি।

Advertisement

বড়জোড়ার একটি সংগঠনের সহায়তায় কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময়ে জীবাণুনাশকের কাজ করেছি বড়জোড়ার ব্লক অফিস, পঞ্চায়েতে, স্কুল ও নানা ব্যাঙ্কে। সামাজিক কাজ করার সময় কেউ গায়ের রং নিয়ে প্রশ্ন তোলেন না। সমাজের অনেকের কাছে রং নিয়ে খোঁটা শুনলেও সমাজের জন্যই কাজ করতে চাই।

কয়েক বছর আগে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল সরকারি চাকরিজীবী এক ফর্সা রঙের যুবকের সঙ্গে। কিন্তু তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা আমার থেকে কম ছিল। তবুও হবু স্বামীর কাছে শুনতে হয়েছিল, ‘তোমাকে কাজের মাসির মতো দেখতে। বাইরে স্ত্রীর পরিচয় দেওয়া যায় না। দয়া করে বিয়ে করছি।’ হবু শ্বশুরমশাইও গায়ের রং নিয়ে হেয় করেন। বাধ্য হয়েই বিয়ের তিন দিন আগে বিয়ে ভেঙে দিই।

তারপরে অনেক ঝড় ঝাপটা সহ্য করতে হয়েছে। বাইরের লোকেরা সমালোচনা করলেও বাড়ির লোকেদের শেষ পর্যন্ত বুঝিয়েছিলাম, এ ভাবে বিয়ে হলে আর যাই, শান্তি পেতাম না। একজন ফর্সা রঙের মানুষের থেকে আমি কোনও অংশে কম নই। বরং অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে। জাতিভেদ প্রথার মতো রং নিয়ে ভেদাভেদ দূর করতেও সচেতনতা জরুরি।

কালীর রং কালো, তবুও সবাই মায়ের পুজো করেন। কিন্তু কালো মেয়ে সমাজে যেন ব্রাত্য। এটা কি দ্বিচারিতা নয়!

তবে বড়জোড়ার রক্তদাতা সংগঠনটির সঙ্গে কাজ করে একটা আলাদা আত্মবিশ্বাস পেয়েছি। মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে গিয়ে বহু মানুষের ভালবাসা পেয়েছি। সেখানে কেউ ভেদাভেদ করে না। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের পুজোয় নতুন জামাকাপড় দিতে বাড়ি বাড়ি যাই। ওরা বা ওদের পরিবারের সবাই যেখানেই দেখা হোক, এগিয়ে এসে কথা বলেন। তাঁদের অকৃত্রিম ভালবাসা সব গ্লানি ভুলিয়ে দেয়। কে কালো, কে ফর্সা সে বিচার তাঁরা করেন না। সমাজের জন্য যাঁরা কাজ করেন, তাঁরা ও করেন না। সেখানে আমার গুণগুলিকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে যে ভালবাসা, যে সম্মান পাই, সেটাই আমার আগামীর রসদ।

অনুলিখন: তারাশঙ্কর গুপ্ত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement