একমনে: স্মার্ট ক্লাসের খুঁটিনাটি শিখছেন শিক্ষকেরা। মহম্মদবাজারে। নিজস্ব চিত্র
স্কুলের দেওয়ালই যেন ব্ল্যাকবোর্ড।
ঘনঘন পাল্টে যাচ্ছে তার রং। শিক্ষকের হাতে থাকা ম্যাজিক পেন-এ ছোঁয়ায় হরেক রঙের কালিতে ফুটে উঠছে পড়ানোর বিষয়বস্তু। কখনও সেই দেওয়ালেই পাঠ্যবইয়ের জটিল বিষয় অডিও-ভিডিওর মাধ্যমে জীবন্ত হয়ে উঠছে। তাতেই বুঁদ খুদে পড়ুয়ারা।
কোনও বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের স্মার্ট ক্লাসের ছবি নয়। দিন কয়েকের মধ্যে এমনই ঘটবে মহম্মদবাজারের পাথর শিল্পাঞ্চল এলাকার ২১টি প্রাথমিক স্কুলে। ‘আলোর পথে’ নামে এমন ভাবনার পিছনে রয়েছেন জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু।
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, ইতিমধ্যেই স্কুলে স্কুলে পৌঁছে গিয়েছে ‘কমিউনিটি কম্পিউটার’ বা কে-ইয়ান। কী ভাবে সেই যন্ত্রে পাঠ দিতে হবে— সে বিষয়ে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষিকাদের প্রশিক্ষণ চলছে ভাঁড়কাটা এনামল হক মল্লিক প্রাথমিক স্কুলে। প্রশিক্ষণ শেষ হলে বীরভূমের প্রত্যন্ত গ্রামের খুদে পড়ুয়াদের কাছে পঠনপাঠন হয়ে উঠবে অনেক বেশি আকর্ষণীয়।
জেলাশাসক বলছেন, ‘‘আমি নিজে ওই মডিউল দেখেছি। অডিও বা ভিডিওর মাধ্যমে পড়ুয়াদের পাঠদানের মান উন্নত হবে। বাচ্চাদের স্কুলে যেতে আগ্রহী করে তুলবে। পাঠ্যবিষয় পড়ুয়াদের কাছে আরও আকর্ষনীয় ও সহজতর উপায়ে তুলে ধরতে শিক্ষক শিক্ষিকাদের কাছে একটি এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হতে পারে।’’
জেলার ২ হাজার ৪০০ প্রাথমিক স্কুল থাকতে এই বিশেষ ব্যবস্থা কেন শুধু মহম্মদবাজারের প্রত্যন্ত এলাকার ২১টি বিদ্যালয়ে চালু করা হচ্ছে?
এর পিছনেও কারণ রয়েছে।
প্রশাসনিক ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, মহম্মদবাজারের পাথর শিল্পাঞ্চলে সব চেয়ে বেশি ক্রাসার রয়েছে হিংলো ও ভাড়কাঁটা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়। মূলত ওই দু’টি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার স্কুলগুলিতে পড়ুয়াদের হাজিরা কমছিল হু’হু করে। শুধু তাই নয়, অধিকাংশ স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা কাগজে-কলমে যা, উপস্থিতির সংখ্যা ছিল অনেক কম। তাতে উদ্বিগ্ন ছিলেন বীরভূমের জেলাশাসক।
এর পরেই সর্বশিক্ষা মিশন কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানতে পারে— প্রতিনিয়ত ভারী যানচলাচনের জন্য স্কুলের পথে দুর্ঘটনার ভয়, ছাত্রীদের প্রতি কটুক্তি, দূষণ, ক্রাসারের কান ফাটানো আওয়াজ তো স্কুলে অনুপস্থিতির পিছনে রয়েছেই, তা ছাড়া বেশির ভাগই ‘প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া’ হওয়ায় সন্তানদের স্কুলে পাঠানো নিয়ে অভিভাবকদের বড় অংশের মধ্যে সচেতনতার অভাবও ছিল। অনেক পড়ুয়া একটু বড় হলেই পাথর শিল্পাঞ্চলের কাজে জুড়ে যেত। সেই সমস্যা দূর করতে গত বছরের অক্টোবরেই কাজ শুরু করে প্রশাসন।
সর্বশিক্ষা অভিযানের জেলা প্রকল্প আধিকারিক বাপ্পা গোস্বামী বলছেন, ‘‘শিশুদের পাঠদানকে আকর্ষণীয় করে তুলতেই স্মার্ট ক্লাসের কথা ভাবা হয়। কে ইয়ান স্কুলে পৌঁছেছে। তবে তার আগেই রেমেডিয়াল টিচিং, স্বাস্থ্য শিবির, অভিভাবক-শিক্ষক সভা, পাঠ্যক্রম বহির্ভূত আনন্দদায়ক শিক্ষা, খেলাধুলো, গান-বাজনার পরিকাঠামো বাড়িয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের আকর্ষিত করার চেষ্টা হয়েছে।’’
তিনি জানান, মিড ডে মিলের মান বাড়াতে ‘কিচেন গার্ডেন’ বা মাশরুম চাষের সঙ্গে আরও একগুচ্ছ পদক্ষেপ করার চেষ্টা শুরু হয়। সবই জেলাশাসকের নির্দেশ মেনে। যাঁর হাত ধরে স্মার্ট ক্লাসের প্রশিক্ষণ পর্ব চলছে, সেই প্রকল্প কো-অর্ডিনেটর উত্তমকুমার হাজরা জানান, বড় রেডিওর মতো দেখতে কে-ইয়ান কম্পিউটার, অত্যাধুনিক প্রজেক্টর, প্রিন্টার, ম্যাজিক পেন, ডিভিডি প্লেয়ার ও অডিও সিস্টেমের মতো ছ’টি বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রের মিলিত রূপ। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত চারটি ক্লাসের প্রতিটি বিষয়ের ‘স্টাডি মেটেরিয়াল’ ওই যন্ত্রে রাখা রয়েছে। এটি সহজে বয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। শিক্ষকেরা গতানুগতিক চক-ডাস্টার ও ব্ল্যাকবোর্ডের ক্লাসঘরই ওই যন্ত্রের সাহায্যে স্মার্ঠ ক্লাসে বদলে পড়ুয়াদের আকর্ষিত করতে পারবেন।
স্থানীয় স্কুলের শিক্ষকদের দাবি, স্কুলপড়ুয়া ও অভিভাবকদের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া মিলেছে। স্মার্ট ক্লাস চালু হলে তা আরও বাড়বে। ভাঁড়কাটা এনামল হক মল্লিক প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক সোমনাথ দাস, বারোমেসে প্রাথমিক স্কুলের টিচার ইন-চার্জ মানস মণ্ডল, কাপাসডাঙা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা অপর্ণা বায়েন, ছোলগাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ভূতনাথ রায় বলছেন, ‘‘নতুন কিছুর প্রতি বাচ্চাদের আগ্রহ থাকে। খেলার ছলে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে পাঠদানে ভাল সাড়া মিলবে বলে আশা করা যায়।’’