রূপকথা যেন বাস্তবের রং-তুলিতে স্বপ্ন তৈরি করছে এই গ্রামে। নিজস্ব চিত্র
অভাব নিত্যসঙ্গী। দু’বেলা দু’মুঠো ভাতের জোগাড় করাই কষ্টসাধ্য। তবু চোয়াল শক্ত ওঁদের। হার না মানা পণ। দু’চোখে সেরা হওয়ার স্বপ্ন। ওঁরা জানেন গ্রামের শক্ত পাথুরে মাঠে ফুটবল পায়ে লড়াই করতে হয় কী ভাবে। কী ভাবে ছিনিয়ে আনতে হয় জয়। তাই বাঁকুড়ার বেঠুয়ালা গ্রামের পাহাড়ি, পাথুরে মাঠে ফুটবল পায়ে প্রতি দিন একটু একটু করে স্বপ্ন বুনে চলেছেন শবর তরুণীরা।
সেই কোন কাল থেকে শবর জনজাতির সমার্থক শব্দ হয়ে উঠেছে দারিদ্র। মহাকাব্যে শবররা কখনও হয়েছেন কিরাত, কখনও বা ব্যাধ। ইংরেজ আমলে মিলেছে অপরাধপ্রবণ জাতির তকমা। আশপাশের গ্রামে চুরি হলেই তখন পুলিশ তুলে নিয়ে যেত শবরগ্রামের মানুষদের। বিনা প্রমাণে। দীর্ঘ কাল বাঁচার লড়াই এমনই পাথুরে জমিতেই লড়েছেন তাঁরা। প্রতিবাদ করেও লাভ হয়নি। কিন্তু এই সময়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে অস্ত্র হিসাবে তাঁরা তুলে নিয়েছেন ফুটবলকে। বাঁকুড়ার বেঠুয়ালা শবরপাড়ার ভাঙা ঘরগুলিতে এখন অন্য স্বপ্নের অবাধ আনাগোনা।
মনে হতেই পারে সিনেমার গল্প। উপন্যাস, কাহিনিও মনে হতে পারে। কিন্তু রূপকথা যেন বাস্তবের রং-তুলিতে স্বপ্ন তৈরি করছে এই গ্রামে। ছোট্ট জঙ্গলে ঘেরা গ্রাম, পাশের এক টুকরো পাথুরে জমিতেই এক সময় ফুটবলের প্রশিক্ষণ শিবির শুরু করেছিলেন প্রসূননারায়ণ দেব ও তাঁর সহযোগীরা। কিন্তু ফুটবল হবে কী করে? জুতো নেই, নেই পোশাক। উপযুক্ত খাবারের অভাব। এত ‘নেই’-এর মধ্যেও ছিল শুধু মনের জোর। অনেক বুঝিয়ে শবর গ্রাম থেকে পাঁচ জন মেয়েকে নিয়ে শিবির শুরু করেছিলেন প্রসূন। দু’বছর আগের সেই সামান্য ফুটবল শিবিরে এখন টগবগে ২০ জন তরুণী। খেলতে চান জঙ্গলমহল কাপে। পিয়ালি, রূপালি, সামন্তীদের তাই গায়ে লাগে না কিছুই। পিয়ালির কথায়, ‘‘আমদের ভাল বুট নাই। পাথর্যা মাঠটায় খেইলতে য্যায়ে পায়ে ল্যাগে যায়। তবু স্বপুনটা আমরা ছাইড়ব নাই। ফুটবল খ্যালেই আমরা দেখ্যায় দিব উয়াদের মতন আমরাও জিততে পারি।’’ বলেই ফের ওঁরা দৌড়ে যান মাঠে। উড়ে আসে ফুটবলে। বুকে করে পায়ে নামিয়ে বাড়িয়ে দেন সতীর্থকে।
গ্রামের ২০ জন শবর মেয়ে প্রশিক্ষণ নেয় নিজস্ব চিত্র
ওঁদের কোচ প্রসূন বলছেন, “প্রথমে শবরপাড়ার কোনও মেয়েই ফুটবলে আগ্রহ দেখায়নি। বারে বারে ওদের বাড়িতে গিয়ে বাবা ও মা-কে বোঝাতে হয়েছে । দু’বছর আগে মাত্র পাঁচ জনকে দিয়ে এই বিনা পয়সার কোচিং শুরু করেছিলাম। আজ সেখানে গ্রামের ২০ জন শবর মেয়ে প্রশিক্ষণ নেয়। জীবনে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলোর প্রয়োজনীয়তা আজ প্রতিটি শবর পরিবার বুঝতে পেরেছে। এখানেই আমি সফল।”
এলাকার বিধায়ক তথা রাজ্যের খাদ্য দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী জ্যোৎস্না মান্ডিও এখন আশায় বুক বেঁধেছেন শবরদের নিয়ে। তিনি বলছেন, “শবর মেয়েরা যে ভাবে পড়াশোনার পাশাপাশি ফুটবল চর্চা করছে, তা শুধু বাঁকুড়া জেলা নয়, রাজ্যেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। মুখ্যমন্ত্রী চান রাজ্যের প্রতিটি গ্রামের মেয়েরা শিক্ষার পাশাপাশি এ ভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই এগিয়ে আসুক। আমি মন্ত্রী ও বিধায়ক হিসাবে ওই শবর মেয়েদের পাশে আছি।’’