পাথুরে মাটিতেই ফলছে আম্রপালি

কাঁটা গাছ আর ঝোপ ঝাড়ে ভরে ছিল উঁচু-নিচু ডুংরি। পাথুরে মাটির সেই উষর ডাঙা এখন সবুজে ভরা। চারিদিকে আম, কাজুগাছ। গাছে গাছে ঝুলছে আম।

Advertisement

দেবব্রত দাস

রাইপুর শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৬ ০৮:০৪
Share:

রাইপুর ব্লকের পুখুরিয়ার একটি স্বনির্ভর দলের সদস্যেরা। ছবিটি তুলেছেন উমাকান্ত ধর।

কাঁটা গাছ আর ঝোপ ঝাড়ে ভরে ছিল উঁচু-নিচু ডুংরি। পাথুরে মাটির সেই উষর ডাঙা এখন সবুজে ভরা। চারিদিকে আম, কাজুগাছ। গাছে গাছে ঝুলছে আম।

Advertisement

জঙ্গলমহলের রাইপুর ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম ঝারি, ভাদলীতে ভরা দুপুরে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে আম্রপালি আর আলফানসো। আর এই সবুজ বাগান নতুন করে বাঁচার দিশা দেখাচ্ছে ওই দুই গ্রামের বাসিন্দাদের।

রাইপুরের সোনাগাড়া পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ঝারি ও ভাদলী— পাশাপাশি দু’টি গ্রাম। ওই দুই গ্রামের মাঝে ফাঁকা পড়ে থাকা ১১৮ একর জমিতে নার্বাডের আর্থিক সহায়তায় স্বনির্ভর গোষ্ঠী গড়ে কাজু ও আম বাগান তৈরি করে স্বনির্ভর হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের একাংশ। এই বাগানের কাজু পাড়ি দিয়েছে গোয়ালতোড়, মেদিনীপুর হয়ে কলকাতা। আবার এই বাগানের আম স্থানীয় রাইপুর বাজার ছাড়িয়ে পাড়ি দিয়েছে কলকাতার বিশ্ব কৃষি মেলাতেও।

Advertisement

রুখা সুখা ডুংরির হঠাৎ কী ভাবে ভোলবদল হল?

গ্রামের বাসিন্দারাই জানাচ্ছেন, ২০০৯ সালে নাবার্ডের তরফে গ্রাম লাগোয়া ফাঁকা জমিতে কাজু ও আম বাগান তৈরির প্রস্তাব দেওয়া হয়। এরপর দুই গ্রামের পুরুষ ও মহিলাদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় আলাদা আলাদা স্বনির্ভর গোষ্ঠী। সরকারি ভাবে পাট্টা পাওয়া ওই জমিতে লাগানো হয় কাজু ও আমচারা। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যেরাই বাগান রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার কাজ করছেন। পাঁচ বছরের মধ্যেই কাজু ও আমগাছে ফলন শুরু হয়েছে। পরিশ্রম করে এখন লাভের মুখ দেখতে শুরু করায় উৎসাহীত ওই বাগানের সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় বাসিন্দারা।

রাইপুরের হলুদকানালি থেকে মটগোদা যাওয়ার রাস্তায় প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে জামবনি মোড়। সেখান থেকে পশ্চিমে কিলোমিটার দুয়েক গেলেই ভাদলী ও ঝারি গ্রাম। দুই গ্রামের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনার পিচ রাস্তা। সেই রাস্তার দু’ধার জুড়ে কাজু ও আমবাগান। ঝারি-ভাদলী বাগিচা স্বনির্ভর দলের সদস্য বানেশ্বর মুর্মু জানাচ্ছেন, সরকারি ভাবে পাট্টা পাওয়া জমিতে চাষাবাদ কিছুই হতো না। খেজুর, কাঁটাগাছ আর ঝোপঝাড়ে ভর্তি ছিল। সেই জমি সমতল করে বাগান তৈরি করা হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘ঝারি মৌজায় ২৫ একর ও ভাদলী মৌজায় ৯৩ একর জমিতে কাজু ও আমবাগান গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতি একরে ৪০টি করে আম ও ৩০টি কাজু গাছ রয়েছে। এ বছরে ১২ কুইন্ট্যাল কাজু বিক্রি হয়েছে। আমবাগান থেকেও ৩০ কুইন্ট্যালের বেশি আম বাজারে বিক্রি হয়েছে। এখনও কিছু আম গাছে রয়েছে।’’

ঝারি-ভাদলী বাগিচা স্বনির্ভর দলের সম্পাদক বিপিন কিস্কু বলেন, “এ বছর গোটা কাজু প্রতি কুইন্ট্যালে ১১ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। বড় সাইজের আম্রপালি আম ৩৫-৪০ টাকা, ছোট ২৫-৩০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে। কাজু ও আম বিক্রি করে আমাদের গোষ্ঠীর সদস্যেরা কমবেশি ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা করে আয় করেছেন।”

এই বাগান তৈরির সঙ্গে যুক্ত কানাই মান্ডি জানান, নার্বাডের তরফে কাজু ও আমগাছের চারা লাগানো হয়েছে। চারাগাছে জল দেওয়ার জন্য বাগানের মাঝখানে বসানো হয়েছে একটি মিনি সাব-মার্সিবল। নিয়মিত চারার পরিচর্যা ও পাহারা দেন স্বনির্ভর গোষ্ঠীর পুরুষ ও মহিলা সদস্যেরা।

জঙ্গলমহলের প্রত্যন্ত এই দুই গ্রামে এক হাজারের বেশি আদিবাসী মানুষের বসবাস। অধিকাংশ মানুষের দিন গুজরান হয় চাষ ও দিনমজুরি করে। কিন্তু বৃষ্টির জন্য প্রকৃতির উপরে নির্ভর করায় চাষবাস হয় নাম কা ওয়াস্তে। স্বাভাবিক ভাবেই বনের কাঠ আর দিনমজুরি করেই পেট চালানো তাঁদের ভরসা ছিল। সরকারের কাছ থেকে পাট্টা পাওয়া ডাঙা জমিতে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে বাগান তৈরি করে এখন তাঁদের দিন বদলে গিয়েছে।

সেই বাগান ঘিরেই এখন দু’চোখে স্বনির্ভরতার স্বপ্ন ঝারি ও ভাদলী গ্রামের আবাল বৃদ্ধবনিতার। ঝারি বীরবাহা বাগিচা দলের নেত্রী সোহিনী মুর্মু বলেন, “বাড়ির কাজ সামলে আমরা ওই বাগান তৈরির কাজ করেছি। দিনের বেলায় পাহারা দিই। গাছের পরিচর্যা করি। গাছের আম পেড়ে নিয়ে রাইপুর বাজারে বিক্রি করতে যাচ্ছি। তবে প্রথম দিকে ফলন কেমন হবে তা নিয়ে সংশয় ছিল। লাভ কি পাব, তা নিয়েও চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু যা পাচ্ছি তাতেই আমরা খুশি।”

ওই মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্য ডমনি মুর্মু বলেন, “গত বছর হাজার পাঁচেক টাকা পেয়েছিলাম। এ বার মনে হচ্ছে বেশিই পাব। বাগানের আম, কাজু বেচে আমরা যা নগদ পাচ্ছি, তাতে টানাটানির সংসারে কিছুটা সুরাহা হচ্ছে।” এলাকা থেকে নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্য তথা সোনাগাড়া পঞ্চায়েতের উপপ্রধান মালতী টুডু জানান, ওই বাগান তৈরি হওয়ার ফলে ঝারি ও ভাদলী গ্রামের বেশ কিছু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। পঞ্চায়েত থেকেও ওই বাগান রক্ষণাবেক্ষণের কাজে গ্রামবাসীকে সাহায্য করা হবে।’’

রাইপুরের বিডিও দীপঙ্কর দাস বলেন, “ওই গ্রাম লাগোয়া জমিতে কাজু ও আমবাগান তৈরি করে স্থানীয় বাসিন্দারা আর্থিক ভাবে কিছুটা হলেও উপকৃত হচ্ছেন। নিঃসন্দেহে ভাল উদ্যোগ।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement