পোস্ত চাষে নজর রাখতে সমীক্ষা

২০০৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যে বীরভূমে পোস্ত চাষ মাদক কারবারিদের বড় আখড়ায় পরিণত করেছিল, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে প্রশাসনিক পদক্ষেপের প্রথম ধাপই ছিল লাগাতার অভিযান। একসময় এনসিবির অফিসারেরা দুবরাজপুর ও খয়রাশোলে তাঁদের অস্থায়ী ঠিকানাও তৈরি করেছিলেন এই মাদক কারবারিদের হাতেনাতে ধরতে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

সিউড়ি শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:৫৫
Share:

নজর মাঠেও। নিজস্ব চিত্র

অজয়, হিংলো আর শাল নদী বরাবর দুবরাজপুর, খয়রাশোল ক’বছর আগেও এনসিবি (নারকোটিক্স কন্ট্রোল ব্যুরো), আবগারি দফতর আর পুলিশের লাগাতার হানা দেওয়ার জায়গা হয়েছিল। সরকারি এজেন্সিগুলোর চোখে ধুলো দিয়ে সরকারি জমিতেই রমরমিয়ে চলত পোস্ত চাষ। পোস্ত’র আঠার সঙ্গে রাসায়নিকের মিশ্রণে কুটির শিল্পের মতো তৈরি হত ব্রাউন সুগার। যা চড়া দামে পাচার হয়ে যেত নানা জায়গায়। আফিম, গাঁজা, ব্রাউন সুগারের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকত স্থানীয় তরুণ প্রজন্ম। এনসিবির সাম্প্রতিক একটি তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রতি বছর বেআইনি পোস্ত ও তা থেকে তৈরি মাদক পাচার করে প্রায় চারশো কোটির ব্যবসা চলে। যার অনেকটাই এখন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়েছে লাগাতার অভিযান চালিয়ে। বীরভূম তার অন্যতম নিদর্শনও বটে।

Advertisement

২০০৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত যে বীরভূমে পোস্ত চাষ মাদক কারবারিদের বড় আখড়ায় পরিণত করেছিল, তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে প্রশাসনিক পদক্ষেপের প্রথম ধাপই ছিল লাগাতার অভিযান। একসময় এনসিবির অফিসারেরা দুবরাজপুর ও খয়রাশোলে তাঁদের অস্থায়ী ঠিকানাও তৈরি করেছিলেন এই মাদক কারবারিদের হাতেনাতে ধরতে। আর তাতেই চোখ কপালে ওঠার মতো তথ্য সামনে আসে। শীতের শুরুতে ধান কাটার পরপরই জমিতে চাষ দিয়ে তৈলবীজ বা সবজি লাগান বহু চাষি। এর মধ্যে সর্ষে ও মুলো লাগানো হয় বেশিরভাগ জমিতে। পোস্ত চারার সঙ্গে এই দুটি চারার সাদৃশ্য থাকায় বহু চাষি সর্ষে বা মুলোর আড়ালে দেদার পোস্ত চাষ শুরু করেন মাদক কারবারিদের মদতে। ২০১২ সালে সরকারি এজেন্সিগুলোর হানায় তাতে রাশ টানা সম্ভব হলে ধূর্ত মাদক কারবারিরা প্রশাসনের চোখে ধুলো দিতে সরকারি জমিতেই পোস্ত চাষ শুরু করে। ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমিগুলিতে তল্লাশি হলেও সরকারি জমি এতদিন চোখ এড়িয়ে যেত এজেন্সিগুলোর আধিকারিকদের। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই চলছিল বেআইনি পোস্ত’র চাষ। ভোটের রাজনীতিকে ঢাল করে মাদক কারবারিরা। আবগারি দফতরের এক কর্তার কথায়, ‘‘সব জেনেও কার্যত হার-পা বাঁধা অবস্থায় ছিলাম তখন। কিন্তু ২০১৭ সাল থেকে সরকার স্পষ্ট নির্দেশ আসে যেভাবেই হোক পোস্ত চাষ রুখতে হবে।’’

গত দু’বছরে প্রশাসন বেশ কড়া হয়েছে এই বিষয়ে। চলতি বছরে আমন ধান কাটার মরসুমেই জেলা জুড়ে বেআইনি পোস্ত চাষ বিরোধী প্রচারে নেমেছিল প্রশাসন। জেলাশাসক ও জেলার পুলিশ সুপারের উপস্থিতিতে গত অক্টোবরেই পোস্ত চাষ বিরোধী একটি বৈঠক হয়েছিল। জেলা অবগারি দফতরের সুপার বাসুদেব সরকার বলেন, ‘‘ওই বৈঠকে জেলার ১৬৭জন পঞ্চায়েত প্রধানকেই ডাকা হয়েছিল। তাঁদের এলাকায় পোস্ত চাষ হচ্ছে কী না তা নিয়ে নজরদারি চালানো-সহ তাঁদের ভূমিকা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এছাড়া বেআইনি পোস্ত চাষের ক্ষতিকারক দিক ও আইন ভাঙার শাস্তি উল্লেখ করে গত মাসের ১৪ তারিখ থেকে মাইকে প্রচার, রেডিওতে বিজ্ঞাপন, লিফলেট বিলি, হোর্ডিং, কথা বলা পতুল-সহ নানা ভাবে প্রচার চলছে।’’ মাঠ থেকে ধান কেটে নেওয়া চলছে এখনও। ব্যক্তিগত জমিতে বা সরকারি জমি ব্যবহার করে কেউ পোস্ত চাষ শুরু করছেন কী না, সেটা খতিয়ে দেখতে মাঠে নেমে এখন থেকেই ‘ফিল্ড সার্ভে’ শুরু করেছেন প্রশাসনের আধিকারিকেরা।

Advertisement

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রতিটি ব্লকে প্রথম দফায় ফিল্ড সার্ভের জন্য চলতি মাসের ৩ থেকে ১৩ তারিখ পর্যন্ত নির্ধারিত হয়েছে। কোন ব্লকে কতদিন ধরে এমন সমীক্ষা হবে, সেটা সেই এলাকায় পোস্ত চাষের পুরনো রেকর্ড দেখে নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু। জেলা জুড়ে ব্লক ভিত্তিক ফিল্ড সার্ভেতে থাকছেন বেআইনি পোস্ত চাষ রোধের নোডাল দফতর আবগারি বিভাগের প্রতিনিধি ও পুলিশ ছাড়াও, এনসিবির অফিসারেরা আর সংশ্লিষ্ট ব্লকের বিডিওর প্রতিনিধি, ভূমি ও ভূমি সংস্কার, বন ও কৃষি দফতরের আধিকারিকেরাও। আধিকারিকদের কথায়, ‘‘ধান ওঠার পরেই ব্যক্তিগত মালিকানাধীন অথবা সরকারি জমি ব্যবহার করে পোস্ত চাষ শুরু করেন চাষিদের একাংশ। নতুন করে চষা জমিতে কি কি ফসল লাগানো হয়েছে সেটা খতিয়ে দেখতেই এই অভিযান।’’ বাসুদেববাবুর সংযোজন, ‘‘প্রশাসনিক বৈঠকে প্রধানদের জানানো হয়েছিল, তাঁর এলাকায় পোস্ত চাষ হচ্ছে না এই মর্মে মুচলেকা দিতে হবে ডিসেম্বর, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে। শুধু প্রধানরাই নন, সরকারি জমি ব্যবহার করে কেউ পোস্ত চাষ করছেন না এই মর্মে লিখিত শংসাপত্র দিতে হবে সেচ, ভূমি ও ভূমি সংস্কার এবং বন দফতরকে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement