খরচ ছয় কোটি, তবু দূষণ

সাহেববাঁধ সংস্কারের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাঁধের চারপাশে চাকচিক্য বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এমনই অভিযোগে সরব হয়েছেন বাসিন্দারা। বাঁধের জল যথারীতি সেই কচুরিপানাতেই ঢাকা পড়েছে। নোংরা জল, আবজর্নাও জলেই ফেলা চলছে।

Advertisement

প্রশান্ত পাল

পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৫ ০০:৫৩
Share:

সরাসরি সাহেববাঁধ থেকেই অনেকে জল তুলে নিয়ে যাচ্ছেন হোটেলে-দোকানে। ছবি: সুজিত মাহাতো।

সাহেববাঁধ সংস্কারের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাঁধের চারপাশে চাকচিক্য বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই হয়নি। এমনই অভিযোগে সরব হয়েছেন বাসিন্দারা। বাঁধের জল যথারীতি সেই কচুরিপানাতেই ঢাকা পড়েছে। নোংরা জল, আবজর্নাও জলেই ফেলা চলছে। আর এ নিয়ে বাসিন্দাদের অভিযোগের তির সাহেববাঁধের মালিকানা থাকা পুরসভার বিরুদ্ধেই।

Advertisement

জাতীয় সরোবরের তকমা পাওয়া এই বাঁধের সংস্কারের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার সাড়ে ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। কাজ রূপায়ণের দায়িত্বে রয়েছে মিউনিসিপ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিরেক্টরেট (এমইডি)। দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে এমইডি, জেলাশাসক, পুরপ্রধান, বিধায়ক প্রভৃতিদের নিয়ে তৈরি একটি কমিটি। কিন্তু পুরবাসীর অভিজ্ঞতা কাজের নামে যা হয়েছে, তাতে বাঁধ বাঁচানোর আসল চেষ্টাটাই দেখা যায়নি।

‘সাহেববাঁধ বাঁচাও কমিটি’-র মুখপাত্র আবু সুফিয়ান বলছেন, ‘‘এই জলাশয় থেকে জল তুলেও অনেক হোটেলে, খাবার দোকানে পাঠানো হয়। কিন্তু জলাশয়ের জল দূষণমুক্ত করার কাজেই ফাঁক থেকে গিয়েছে।’’ তাঁর মতে, এই জলাশয়কে বাঁচাতে প্রথম ও প্রধান কাজই হওয়া উচিত ছিল বাঁধের পাশে বড় ড্রেন তৈরি করা। সেই ড্রেন দিয়েই নোংরা জল শহরের বাইরে পড়ার দরকার। কিন্তু সেই কাজটাই তো হল না। ফলে সবসময়ই নোংরা জল জলাশয়ের জলে মিশছে।’’

Advertisement

বছর দুয়েক আগে বাঁধ সংস্কারের প্রথম দিকে গভীরতা বাড়াতে মাটি কাটা হয়েছিল। তা দেখে মানুষজন মনে করেছিলেন, এ বার সত্যিকারের কাজ হচ্ছে। কিন্তু বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা, মাটি তুলে ফের জলাশয়ের পাড়েই রাখা হল। ফলে সময়মতো না তোলায় মাটির অনেকটাই ফের বাঁধেই গিয়ে পড়ে বলে তাঁদের অভিযোগ। আবু সুফিয়ানের মতে, বাঁধের চারপাশে যে ভাবে বাড়ি তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তাও ঠিক নয়। এ রকম একটি সরোবরের পাশে বড়বড় নির্মাণ কতটা বিধিসম্মত সে প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘মাটি কেটে তা পাড়ের পাশে ফেলায় কমে গিয়েছে জলাভূমিও। কতটা মাটি কাটা হল, গভীরতাই বা কতটা বাড়ল আমরা কেউ জানতেই পারলাম না।’’

বিরোধীরাও একই দাবিতে সরব হয়েছেন। কংগ্রেসের কাউন্সিলর সুদীপ মুখোপাধ্যায় ও বিভাস দাস বলেন, ‘‘কোন খাতে কত টাকা খরচ হল তা আমরা জানতে চাই। কেন না সাহেব বাঁধ সংস্কারের সঙ্গে পানীয় জলের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জড়িত। অথচ সেই জল দূষণমুক্ত না করে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে পাড়ে রাস্তা তৈরি হল। সেই রাস্তাও অল্পদিন পরেই ভেঙে গিয়েছে। কিন্তু জলাশয় কচুরিপানায় ভর্তি হয়ে মাঠের মতো হয়ে গিয়েছে।’’ একই সঙ্গে তাঁরা সাহেববাঁধের পাড়ে তৈরি শৌচালয়টি তৈরি করেও তালা মেরে রাখা হয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

বস্তুত এই সাহেববাঁধ সংস্কারের কাজ নিয়ে পুরুলিয়ার বিধায়ক কে পি সিংহ দেও নিজেই বিধানসভায় প্রশ্ন তুলেছিলেন (তখন তিনি পুরপ্রধান হননি)। এখন তিনি বলছেন, ‘‘সাহেববাঁধের জল যে দূষিত তা তো নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। ড্রেনের নোংরা জল এসে মিশছে জলাশয়ে। এ দিকে বাঁধের ফিল্টার বেডও অচল।’’ তিনিও সাহেবাঁধ সংস্কারের কাজ দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা কমিটিতে রয়েছেন। তিনি জানান, বাঁধের উন্নয়নের জন্য সাড়ে ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। তার মধ্যে ছয় কোটির বেশি টাকার কাজ হয়েছে বলে জানি। কিন্তু বাঁধ বাঁচাতে কিছু কাজ বাকি রয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘বর্তমান পুরসভার প্রথম লক্ষ্য হল পানীয় জল সুনিশ্চিত করা। তারমধ্যে সাহেববাঁধ অন্যতম।’’ তিনি এ জন্য সবার সদিচ্ছা ও উদ্যোগ চাইছেন।

আবু সুফিয়ানের অভিযোগ, ‘‘আমরাও প্রশাসনের কাছে সাহেবাঁধ সংস্কারের বেশ কিছু প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তা মানা হয়নি। কমিটিতেও আমাদের প্রতিনিধি রাখার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। শোনা হয়নি। শুনেছিলাম, যে এলাকা দিয়ে সাহেববাঁধে জল প্রবেশ করে, সেই এলাকা জুড়ে সুন্দরবন অঞ্চলের গাছ লাগানো হবে। তাতে জল অনেকটা শোধন হয়ে বাঁধে ঢুকবে। সেই কাজও হয়নি। সংস্কারের কাজ নিয়ে পুরো ধোঁয়াশায় রাখা হয়েছে।’’ কে পি সিংহ-ও বলছেন, ‘‘কোন কাজ হয়েছে, কোন কোন কাজ হয়নি, কোথায় সমস্যা, কেন হচ্ছে না এ সমস্ত বিষয়গুলি জানা দরকার। সে জন্য কয়েকদিন আগে এমইডি-র প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলাম। কিন্তু বিরোধীদের বাধায় সেই বৈঠকই ভেস্তে যায়। সে দিন বৈঠক হলে কাজটা এগোতে পারতাম।’’ তবে সাহেববাঁধ নিয়ে এমইডি কর্তৃপক্ষের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

পুরপ্রধান জানান, এই জলাশয়কে বাঁচাতে তিনি শীঘ্রই কলকাতায় বৈঠকে বসবেন। কেন শৌচালয় তৈরির পরেও খুলে দেওয়া যায়নি, কেন বাঁধের ফিল্টার বেড অচল হয়ে পড়ে রয়েছে, নর্দমার জলই বা কেন জলাশয়ে ঢুকছে, ড্রেনের কাজই বা কী অবস্থায় রয়েছে, কেনই বা নতুন রাস্তা নির্মাণের পরই ভেঙে পড়েছে তা নিয়ে তিনি সরব হবেন। তাঁর কথায়, ‘‘সবাইকে নিয়েই আমরা সাহেববাঁধ বাঁচাতে চাই।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement