শ্রদ্ধা: কুমির গ্রামের স্মরণ বেদির সামনে সর্বেশ্বর মাহাতো। নিজস্ব চিত্র
একই সঙ্গে বঙ্গভুক্তির আন্দোলন শুরু করেছিলেন তাঁরা। সেই সময়ের মানভূমের একটা অংশ সেই আন্দোলনের জেরে পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। একটা অংশ হয় না। তাতে কী? বাংলা ভাষা এখনও মুখর ঝাড়খণ্ডের পূর্ব সিংভূম জেলার কুমির গ্রামে। প্রতি বছর ৮ অক্টোবর ওই গ্রামে বসে ‘রাষ্ট্র শহিদ সম্মান মেলা’। ফিরে ফিরে আসে স্মৃতি। আরও বেঁধে বেঁধে থাকার টান।
রবিবার হয়ে গেল এ বছরের মেলা। মেলার মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন পুরুলিয়ার প্রথম সাংসদ প্রয়াত ভজহরি মাহাতোর ছেলে দীপক মাহাতো। তিনি বলেন ‘‘১৯৪২ সালের ৮ অক্টোবর বাবার নেতৃত্বে এই মাঠে সভা হচ্ছিল। ঠিক হয়েছিল পটমদা থানায় অভিযান চালিয়ে ওই থানা ব্রিটিশদের কবলমুক্ত করা হবে। শাসকের কানে সেই খবর পৌঁছে যা। বান্দোয়ান থানা থেকে পুলিশ এসে সভায় গুলি চালায়।’’ সেই গুলিতে গুরুতর জখম হয়েছিলেন ৬ জন, আজও সেই ছবি চোখের সামনে ভাসে ছিয়ানব্বই বছরের সর্বেশ্বর মাহাতোর। ১৯৪২-এর অগস্ট আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। পরে বঙ্গভুক্তির আন্দোলনেও। বলেন, ‘‘বঙ্গভুক্তির আন্দোলনের সময়ে সভা, সমিতি, জমায়েত হয়েছে এখানে। অনেক ইতিহাসের সাক্ষী এই মাঠ।’’ সর্বেশ্বরবাবু জানান, অনেক চাপের মুখেও ভাষার জন্য লড়ে গিয়েছেন তাঁরা। যেমন লড়েছিলেন স্বাধীনতার জন্য।
৬২ বছর আগে ওই এলাকা ছিল অখণ্ড মানভূম জেলায়। ১৯৫৬ সালের ১ নভেম্বর থেকে তার অবলুপ্তি ঘটে। প্রথমে বিহার, এখন ঝাড়খণ্ডে পড়ে এলাকাটি। অখণ্ড মানভূম জেলার মধ্যে ৩১টি থানা ছিল। মহকুমা ছিল দু’টি— পুরুলিয়া ও ধানবাদ। জেলার ইতিহাস গবেষক প্রদীপ মণ্ডল বলেন, ‘‘স্বাধীনতার পরে লোকসেবক সঙ্ঘের দীর্ঘ আন্দোলন চলেছিল। শেষে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের রায় বেরোয়। পুরুলিয়া মহকুমার মধ্যে থাকা ২১টি থানার মধ্যে ১৬টি নিয়ে পুরুলিয়া জেলা গঠন হয়। শিল্পপতিদের কথা ভেবে পুরুলিয়া মহকুমার চাষ, চন্দনকিয়ারি, ইচাগড়, পটমদা ও চান্ডিল থানা রেখে দেওয়া হয় বিহারে। আর ধানবাদ মহকুমার সব থানাই থাকে বিহারে।’’ সর্বেশ্বরবাবু বলেন, ‘‘১৯৪৮ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত কুমির গ্রামের এই মাঠ থেকেই আমরা সবাই একসঙ্গে আন্দোলন করেছিলাম। ফল হল আলাদা। পুরুলিয়া জেলার বাসিন্দারা তাঁদের বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতি বজায় রাখতে পেরেছেন। আমরা লড়াই করে চলেছি।’’ লোকসেবক সঙ্ঘের পক্ষে মোহনচন্দ্র মাহাতো, সুশীল মাহাতোদের জানান, ৮ অক্টোবর তাঁরা ফিরে ফিরে যান কুমির গ্রামে, সহমর্মিতা নিয়ে।
রবিবারের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শালবনির তৃণমূল বিধায়ক শ্রীকান্ত মাহাতো, ঝাড়খণ্ডের যুগশলাই কেন্দ্রের আজসু পার্টির বিধায়ক রামচন্দ্র সহিস। তাঁরা বলেন, ‘‘কুমির গ্রামের সঙ্গে অনেক ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে। এটা একটা গর্বের ব্যাপার। এখানে না এলে জানতেই পারতাম না।’’ সেই ইতিহাসকে ধরে রাখতে তাঁরা সমস্ত রকম সাহায্যের আশ্বাস দেন। মানবাজারের মানভূম কলেজের শিক্ষক, লোকগবেষক তপন পাত্র বলেন, ‘‘বাংলার সংস্কৃতি রক্ষায় অখণ্ড মানভূম জেলার বাসিন্দারা একজোট হয়ে লড়াই করেছিলেন। তখনকার দিনে দুই রাজ্যের প্রধানরা বাংলার সংস্কৃতি রক্ষার আবেগকে মর্যাদা দেননি। মানভূম জেলার প্রায় আর্ধেক অংশের মানুষকে তাঁদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। বাংলা সংস্কৃতি যাঁদের রক্তে, তাঁদের সাংস্কৃতিক শিকড় উপড়ে ফেলা হয়েছিল। এই যন্ত্রণা কোনও দিন ভোলার নয়।’’