পুরনো গরুহাট এলাকায় জোরকদমে চলছে নতুন জল প্রকল্পের রিজার্ভার তৈরির কাজ।—নিজস্ব চিত্র।
পুরভোটের প্রচারে বেরিয়ে জলসমস্যার প্রশ্নে বিদ্ধ হতে হয়েছিল শাসকদলকে। এ বার তাই পুরবোর্ডের ক্ষমতায় এসে শহরে জল সরবরাহে স্বাবলম্বী হতে চাইছে রঘুনাথপুর পুরসভা। শুধু শহরের প্রতিটি রাস্তায় নয়, এ বার চাইলে প্রতিটি বাড়িতে জলের লাইন পৌঁছে দিতে চায় তৃণমূল পরিচালিত এই পুরবোর্ড। তবে নিখরচায় নয়। বাড়িতে জলের লাইন নিলে বিনিময়ে সামান্য জলকর দিতে হবে উপভোক্তাকে। এমনই জানাচ্ছেন নতুন পুরপ্রধান ভবেশ চট্টোপাধ্যায়।
পুরপ্রধানের কথায়, ‘‘দায়িত্ব পাওয়ার পরেই আমরা সিদ্ধান্ত নিই শহরে জলের সঙ্কট দূর করতে হবে। সেই অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকারের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে জল প্রকল্প নির্মাণের বাকি কাজ দ্রুত গতিতে শুরু করা হয়েছে।” তাঁর দাবি, আগামী আগস্ট মাসের মধ্যেই শহরের ছ’টি ওয়ার্ডে নতুন প্রকল্প থেকে জল সরবরাহ শুরু করে দেওয়া হবে। বাকি সাতটি ওয়ার্ডকে অক্টোবর মাসের মধ্যে নতুন প্রকল্পের আওতায় আনা হবে।
গত প্রায় ১০-১২ বছর ধরে রঘুনাথপুর শহরে জল সরবরাহ করে আসছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের ইন্দো-জার্মান জল প্রকল্প। পাঞ্চেত জলাধারের জল এই প্রকল্পে শহরের অনেকখানি এলাকার তৃষ্ণা মেটালেও তা সবার কাছে পৌঁছতে পারেনি। তবুও ওই প্রকল্পে যেমন কিছু এলাকায় রাস্তার পাশে কল থেকে জল নেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তেমনই কিছু এলাকায় বাড়ি বাড়ি জলেরও ব্যবস্থা রয়েছে। পুরসভার হিসেবে, তাতে শহরের ৩৫ শতাংশ বাড়িতে জলের ব্যবস্থা করা গিয়েছে। সে জন্য পুরসভা দীর্ঘদিন ঘরে কিছু জলকর নিয়ে আসছে।
এ বার জলের জোগান বাড়িয়ে বাকি এলাকাতেও বাড়ি বাড়ি জল দিতে চাইছে পুরসভা। পুরপ্রধান বলেন, ‘‘দরিদ্র মানুষদের রাস্তার পাশের কল থেকে বিনামূল্যে জল দেওয়া হবে। তবে সম্পন্ন মানুষজন বাড়িতে সংযোগ নিলে সামান্যই জলকর নেওয়া হবে। তা প্রকল্প চালানোর কাজে খরচ করা হবে।’’ কিন্তু তৃণমূল সরকার যেখানে জলকরের বিপক্ষে সেখানে তাঁরা কী ভাবে জলকর নেবেন? পুরপ্রধানের যুক্তি, ‘‘অনেক আগে থেকেই এখানে জলকর চালু রয়েছে। আমরা নতুন করে তা চালু করছি না। তাছাড়া পরিষেবা পাওয়ার জন্য অনেক সম্পন্ন পুরবাসী ওই সামান্য জলকর দিতেও রাজি আছেন।’’
পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমানে নিতুড়িয়ার লক্ষণপুরের ইন্দো-জার্মান জল প্রকল্প থেকে শহরে জল সরবরাহ করা হয় দৈনিক ২ লক্ষ ১০ হাজার লিটার। কিন্তু শহরের কমবেশি ৪০ হাজার বাসিন্দার জন্য এই পরিমাণ জল যথেষ্ট নয়। পুরসভার হিসেবে দৈনিক অন্তত চার লক্ষ লিটার জলের প্রয়োজন। ফলে শহরের প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডেই কান পাতলেই শোনা যায় জল সঙ্কটের অভিযোগ। বিশেষ করে ১, ৩, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে জলের অভাব মারাত্মক আকার নিয়েছে। বর্তমান পুরবোর্ডের দাবি, জলের চাহিদা ও জোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য না থাকায় সঙ্কট তৈরি হয়েছে শহরে।
এই প্রেক্ষাপটেই পুরসভা কেন্দ্রীয় সরকারের বিআরজিএফ (স্পেশ্যাল) প্রকল্পে পৃথক ভাবে আরও একটি জল প্রকল্প গড়তে তিন বছর আগেই উদ্যোগী হয়েছিল পুরসভা। কিন্তু সে সময়ে কাজ হয়নি বলে অভিযোগ বিরোধীদের। আর এ বার নতুন বোর্ড নতুন উদ্যোমে ওই ফেলে রাখা কাজই তাড়াতাড়ি শেষ করতে মাঠে নেমে পড়েছে। পুরসভা সূত্রের খবর, ১৭ কোটি ৪৪ লক্ষ টাকা ব্যয়ে এই জল প্রকল্প গড়া হচ্ছে। যার মধ্যে কমবেশি ১০ কোটি টাকা হাতে পেয়েছে পুরসভা। কী হবে এই প্রকল্পে? পুরসভার বাস্তুকার বিজয়কুমার মনি জানাচ্ছেন, নতুন জল প্রকল্পে শহরে জলের ঘাটতি মেটানো হবে। ১২ ও ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে জলস্তর সংক্রান্ত সমীক্ষা চালিয়ে ভূগর্ভস্থ জল মেলায় পরে পাঁচটি গভীর টিউবয়েল (বোরিং) করা হয়। এ ছাড়াও ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের বেহাল হয়ে পড়া পুরসভারই জামসোল প্রকল্পটির নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করা হবে। ফলে সেখানেও জল মিলবে। সব মিলিয়ে এই ছ’টি জায়গা থেকে পুরসভা দৈনিক জল পাবে কমবেশি ১ লক্ষ লিটার। পাশাপাশি ১৩ নম্বর ওয়ার্ডেরই বারিকবাঁধ নামের পুকুরে ‘ইনটেক ওয়েল’ তৈরি করা হচ্ছে। সেখান থেকে দৈনিক ৪০ হাজার লিটার জল মিলবে। ফলে জলের চাহিদার অনেকটাই এই উৎসগুলি থেকে পাওয়া যাবে বলে পুরসভা মনে করছে। এ ছাড়া, বাকি জলের সংস্থান করতে পাশের খাজুরা পঞ্চায়েত এলাকায় ইন্দো-জার্মান প্রকল্পের একটি গভীর টিউবয়েল থেকে জল তুলতে চাইছে পুরসভা। পুরপ্রধানের দাবি, ‘‘ওই পঞ্চায়েতটি তৃণমূল পরিচালিত হওয়ায় আশাকরি রঘুনাথপুরের বিধায়ক পূর্ণচন্দ্র বাউড়ির মাধ্যমে আলোচনা করে তাদের অনুমতি পেতে সমস্যা হবে না।’’ নতুন উৎসগুলি থেকে জল তুলে পাইপ লাইনের মাধ্যমে রিজার্ভারে পাঠানোর আগে পরিশোধন করার জন্য চেলিয়ামা রোডে বারিক বাঁধের কাছে এবং পুরনো হাটের পাশে দু’টি সিআরসি (ক্লিয়ার রিজার্ভার ওয়াটার) তৈরি শুরু হয়েছে।
পুরসভার প্রথম বৈঠকেই জল সমস্যা নিরসনে দ্রুত কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নতুন বোর্ড। কিন্তু তাতে তিন বছর আগে কেন্দ্রীয় সরকারের এই প্রকল্পের টাকা পেয়েও কেন কাজ করতে দেরি হল, সে প্রশ্ন থেমে নেই। বিজেপি কাউন্সিলর শুভঙ্কর কর ও সিপিএমের কাউন্সিলর প্রদীপ দাসের বক্তব্য, ‘‘জল সমস্যা নিরসনে পুরসভার উদ্যোগেকে সমর্থন জানিয়েছি। তবে কেন ওই টাকা এতদিন ফেলে রাখা হল তার সদুত্তর চাই।’’ সদুত্তর মেলেনি নতুন পুরপ্রধানের কাছেও। তবে তৃণমূল সূত্রেই জানা যাচ্ছে, জল প্রকল্প নির্মাঁণে বিগত পুরবোর্ড কিছুটা গড়িমসি করেছিল। এ ছাড়াও পাইপ লাইন পাতার জন্য পুরুলিয়া-বরাকর রাজ্য সড়কে খোঁড়াখুঁড়ির অনুমতিও পুরসভাকে দেয়নি পূর্ত দফতর। ভবেশবাবু বলেন, ‘‘অতীতে কী হয়েছে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে রাজি নই। দলমত নির্বিশেষে নতুন বোর্ডের সকলেই চাইছে জল সমস্যার স্থায়ী সমাধান করতে। তাই জল প্রকল্প দ্রুত রুপায়ণের সঙ্গে শহরের আরও ৩০টি নতুন টিউবয়েল বসাতে চলেছি আমরা।’’
আগামী গ্রীষ্মে তৃষ্ণা মিটবে কি না, সে দিকেই তাকিয়ে পুরবাসী।