নীতির ঘরে দুর্নীতি
Primary Teacher

‘তোর টাকাও কি সেখানে’! বিদ্ধ শিক্ষকেরা

এক দশকের শিক্ষক নিয়োগ আতস কাচের নীচে। ধৃত প্রাক্তন মন্ত্রী থেকে আমলারা। উদ্ধার টাকার স্তূপ। কালির দাগ লেগেছে শিক্ষকদের সম্মানেও।

Advertisement

শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল

পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৮:৩৫
Share:

প্রাক্তন মন্ত্রীর ‘ঘনিষ্ঠের’ ফ্ল্যাটে উদ্ধার করা টাকা। ছবি সৌজন্যে ইডি

বাজারে দীর্ঘদিনের আনাজ বিক্রেতা এক দিন গলার স্বর খাদে নামিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘শুনছি পাড়ার অমুক বাড়ির ছেলেটা টাকা দিয়ে প্রাইমারিতে ঢুকেছিল। মন্ত্রী-আমলাদের ধরপাকড় শুরু হওয়ায় ওঁর বাড়ির লোকেরা খুব চিন্তায় রয়েছে। স্যার আপনার তেমন কোনও সমস্যা নেই তো?’’ প্রশ্নটা শুনে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন নিতুড়িয়া এলাকার এক হাই স্কুলের শিক্ষক। কয়েক বছর শিক্ষকতা করা ওই যুবক বলছেন, ‘‘ভাবছি অন্য কোনও চাকরির চেষ্টা করব।”

Advertisement

এটা উদাহরণ মাত্র। কিন্তু রাজ্যে জুড়ে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে একের পর এক ধরপাকড় শুরু হওয়ায় বাসে, ট্রেনে, আড্ডায় এমনই নানা প্রশ্ন, টিপ্পনীর শিকার হতে অনেক শিক্ষককে। ‘‘শিক্ষকতা করি এই পরিচয় দিতেই এখন দ্বিধায় পড়তে হচ্ছে”— শিক্ষক দিবসের আগে পুরুলিয়া জেলার এক শিক্ষকের এই মন্তব্যে যেন অনেক শিক্ষকের যন্ত্রণার ছবিটাই ফুটে উঠেছে।

নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ঘিরে মামলায় হাইকোর্টের নির্দেশে বিভিন্ন জেলার কিছু শিক্ষকের চাকরি গিয়েছে। সেই তালিকায় অবশ্য পুরুলিয়ার কারও নাম নেই। শিক্ষকদের দাবি, স্কুল সার্ভিস কমিশন বা টেট— দুই পরীক্ষাতেই পুরুলিয়া জেলার প্রচুর ছেলেমেয়ে চাকরি পেয়েছেন, এমনটা নয়। কিন্তু প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ের দু’টি ফ্ল্যাটে টাকার স্তূপের ছবি দেখার পর থেকেই অনেকে যেন তাঁদের দিকে বাঁকা চোখে তাকাচ্ছেন, দাবি করছেন শিক্ষকদের একাংশ।

Advertisement

স্কুল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে চাকরি পাওয়া রঘুনাথপুরের এক যুবকের কথায়, ‘‘বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় অবধারিত ভাবে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির প্রসঙ্গ উঠছে। বন্ধুরা কেউ কেউ টিপ্পনী কাটছে, ‘ওই টাকার স্তূপে তোর দেওয়া টাকাগুলো কোথায় রে’। বুঝতে পারি, সবটাই রসিকতা। কিন্তু প্রসঙ্গটা অস্বস্তিকর। তারপর থেকে কয়েকদিন আড্ডা দিতে যাইনি।”

প্রধান শিক্ষকদের সংগঠন ‘অ্যাডভান্সড সোসাইটি ফর হেডমাস্টার্স অ্যান্ড হেডমিসট্রেস’-এর পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক অভিষেক মিশ্র জানাচ্ছেন, ধরে নেওয়া যেতে পারে শিক্ষক নিয়োগে কিছু মাত্রায় দুর্নীতি হয়েছে। কিন্তু সবাই যে দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছেন, বিষয়টা আদপে তা নয়। নতুন চাকরি পাওয়া শিক্ষকদের কাছে বিষয়টি যথেষ্ঠ অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

শিক্ষকদের সমাজ আলাদা চোখে দেখে। এই দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরে সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে যেন আঘাত লাগছে বলে মনে করছেন ‘মাধ্যমিক শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সমিতি’-র পুরুলিয়া জেলা সহ-সভাপতি কাজল রায়। তিনি বলেন, ‘‘কয়েকজন শিক্ষকের নিয়োগের দুর্নীতি এই পেশার সঙ্গে জড়িত সবার সম্মানহানি করেছে। সমাজে শিক্ষক হিসেবে পাওয়া সম্মান কতটা ফিরবে, সন্দেহ রয়েছে।’’

এবিটিএ-র পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক ব্যোমকেশ দাস শাসকদলকে এ জন্য দুষছেন। তাঁর অভিযোগ, ‘‘দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল সরকারের জন্য শিক্ষকদের সম্মান মাটিতে লুটোচ্ছে। শিক্ষকদের আজ রাজ্য সরকারে জন্যই অস্বস্তিতে পড়তে হচ্ছে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী এ নিয়ে শিক্ষকদের কাছে ক্ষমা পর্যন্ত চাননি।” যদিও তৃণমূলের শিক্ষক সংগঠনের জেলা সভাপতি সত্যকিঙ্কর মাহাতোর দাবি, ‘‘শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি হয়েছে কি না, সেটা আদালতের বিচারাধীন বিষয়। তবে তার আগেই মুখ্যমন্ত্রী প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেন না।”

শিক্ষকদের এই সঙ্কট রয়েছে পড়শি জেলাতেও। (চলবে)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement