‘কোর ব্যাঙ্কিং সিস্টেমে’ টাকার লেনদেন চলছে। ইদানিং আবার শুরু হয়েছে বোতল বন্দি গঙ্গাজল বিক্রির কাজও। সেই সব কাজ সারার ফাঁকে চিঠিই আর রেজিস্ট্রি করতে চাইছেন না ডাক বিভাগের কর্মীরা। ফিরিয়ে দিচ্ছেন ডাকঘরে আসা লোকেদের। বীরভূমের বেশ কিছু ডাকঘরে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই হচ্ছে। শুধু সাধারণ মানুষই নন, একই অভিযোগ তুলে সরব হয়েছে জেলা ভূমি ও ভূমিকা সংস্কার দফতরও। দফতরের দাবি, ডাকবিভাগের এমন অসহযোগিতার জন্য জমি কেনাবেচার পরে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ— মালিকানা পরিবর্তনের (মিউটেশন) কাজে বিলম্ব হচ্ছে।
অতিরিক্ত জেলাশাসক তথা জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক নীলকমল বিশ্বাস বলছেন, ‘‘নোটিসের চিঠি রেজিস্ট্রির ক্ষেত্রে অভিযোগ মিথ্যা নয়। আমাদের দফতর এ নিয়ে সমস্যায় পড়েছে। দ্রুত সমস্যা মেটানোর জন্য জেলার পোস্টাল সুপারিন্টেন্ডেন্টের সঙ্গে কথা বলব।’’
ভূমি দফতর সূত্রের খবর, যে বা যাঁরা জমি বা সম্পত্তি কিনছেন তাঁরা মালিকানা পরিবর্তন করতে চেয়ে প্রথমে ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরে আবেদন করেন। বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য একটি শুনানির দিন নির্দিষ্ট করে দফতর। ওই আবেদনের সঙ্গেই আবেদনকারী নিজেই নির্দিষ্ট সংখ্যক কিছু খাম এবং প্রতিটি খামে ২২ টাকার ডাকটিকিট সাঁটিয়ে দিতে হয়। খাম সংখ্যায় কমপক্ষে দু’টি (দাতা ও গ্রহীতার জন্য), প্রয়োজনে ছ’টি পর্যন্ত হতে পারে। আবেদন পাওয়ার পরে শুনানির দিন ধার্য করে দফতর আগে জমিটি যাঁর নামে নথিবদ্ধ ছিল এবং বর্তমানে যিনি সেই সম্পত্তি কিনছেন, এমন সকলকে রেজিস্ট্রি চিঠি মারফত নোটিস পাঠিয়ে ডেকে পাঠায়।
দুবরাজপুর ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক বিশ্বজিৎ ঘোষের অভিযোগ, ‘‘সেই নোটিস পাঠানো নিয়েই যাবতীয় অশান্তি ও সমস্যা। কারণ খামের উপর বিএলআরও অফিসের স্ট্যাম্প দেখলেই আর সেই চিঠি রেজিস্ট্রি করতে চাইছে না ডাকঘর। সেখানকার কর্মীদের বক্তব্য, তাঁদের ‘এত কাজ করার লোক নেই’।’’ শেষমেশ নোটিস পাঠাতে একটি অন্য উপায় ঠিক করেন বিশ্বজিৎবাবুরা। আবেদনকারীকে দিয়েই নোটিস ডাকে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। যদিও তাতেও সমস্যা মেটেনি। বিশ্বজিৎবাবুদের কথায়, ‘‘আগে দফতরের কর্মীরা কষ্ট পেয়েছেন। এখন জমির ক্রেতারা।’’
কী বলছেন ভুক্তভোগীরা?
দুবরাজপুর ডাকঘরে গিয়ে খুব একটা ভাল অভিজ্ঞতা হয়নি কামালউদ্দিন শেখ, মজিবুর শেখ, পূর্ণিমা গড়াই, শামিমা বিবি এবং তাপস রুজদের। তাঁদের ক্ষোভ, ‘‘জমি কিনে আবেদন করলে শুনানির জন্য ডাক পেতে এমনিতেই কমপক্ষে ছ’মাস গড়িয়ে যায়। পরে নোটিস পাঠানোর ব্যবস্থা হয়। সেই নোটিসও যদি যথা সময়ে না পৌঁছয়, তা হলে আমরা কোথায় যাব?’’ প্রত্যেকেরই দাবি, ভূমি দফতরের পরামর্শে তাঁরা নিজেরাই খামগুলো রেজিস্ট্রি করতে ডাকঘরে গিয়েছিলেন। কিন্তু দুবরাজপুরের মূল পোস্ট অফিস-সহ সংলগ্ন চারটি ডাকঘরে কোথাও-ই সেই কাজ করানো যায়নি। প্রতিটি ডাকঘরই তাঁদের ফিরিয়ে দিয়েছে। শামিমাদের কথায়, ‘‘এক একটি ডাকঘরে দিনে ৫-৭টির বেশি চিঠি রেজিস্ট্রিই করা হচ্ছে না। ডাকঘরে গেলেই কর্মীরা সাফ জানিয়ে দিচ্ছেন, ‘এখন হবে না’।
ভূমি দফতর সূত্রের খবর, যদিও সমস্ত ব্যবস্থা অনলাইনে হয়ে যাওয়ায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছিল। ডেটা এন্ট্রি করার কর্মীর অভাব ছিল। ছিল মাঝে মধ্যেই লিঙ্ক না থাকার সমস্যাও। কিন্তু দ্রুত মিউটেশন সারার জন্য রাজ্য সরকারের কাছ থেকে নির্দেশ আসার পরে কাজে কিছুটা গতি এসেছে। বর্তমানে শুধু দুবরাজপুরেই প্রতিদিন গড়ে ৬০-৭০টি পার্টিকে (এক একটির জন্য গড়ে চারটি চিঠি) অর্থাৎ ২০০-২৫০ নোটিসের চিঠি পাঠানোর প্রয়োজন। কিন্তু এত সংখ্যক চিঠি রেজিস্ট্রি করতে হবে বলে পিছিয়ে যাচ্ছেন ডাকবিভাগের কর্মীরা। আর জেলা ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতর সূত্রে জানা যাচ্ছে, এই সমস্যা কেবল দুবরাজপুর ব্লকেরই নয়, জেলার বেশ কয়েকটি ব্লকে একই দুর্ভোগ চলছে। মহম্মদবাজার ব্লকে তো শেষ পর্যন্ত দফতরের কর্মীদের দিয়েই নোটিস পাঠানোর ব্যবসা করতে হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রধান সমস্যা হল ঠিক ঠিকানায় চিঠি পৌঁছে দেওয়া।
চিঠি রেজিস্ট্রি করতে সমস্যা কোথায়? এ ব্যাপারে সবার আগে কর্মী সংখ্যায় ঘাটতির কথাই তুলছে দুবরাজপুরের মতো ডাকঘরগুলি। পাশাপাশি ‘কোর ব্যাঙ্কিং সিস্টেম’ চালু হওয়ায় কাজের চাপ বেড়ে যাওয়ার কথাও বলা হচ্ছে। যদিও সেই যুক্তি মানতে নারাজ খোদ জেলার পোস্টাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট পরিমল মিত্র। তিনি বলছেন, ‘‘রে়জিস্ট্রি চিঠি ফেরত দেওয়ার কোনও কারণ নেই। দুবরাজপুরের মূল ডাকঘর-সহ পাশাপাশি সব ক’টি ডাকঘরে কোথাও কোনও কর্মীর অভাব নেই। তার পরেও কারও সঙ্গে এমনটা হয়ে থাকলে খোঁজ নিয়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ করব।’’