দেওয়ালে যুযুধান। ভোট প্রচারে এ ভাবেই ছড়ায় ভরে গিয়েছে শহরের বিভিন্ন দেওয়াল। —নিজস্ব চিত্র
দেওয়ালে জুড়ে লেপ্টে আছে অন্ত্যমিল—কোথাও চিমটি তো কোথাও নিপাট খুনসুটি। আষ্টেপৃষ্টে ছড়ায় মুড়েছে সাঁইথিয়া।
বীরভূমের এই প্রান্তিক গঞ্জ যে এমন ছড়াপটু তা কেউ জানত? স্থানীয় এক বামপন্থী নেতার কথায়, ‘‘রাজনীতির কারবারিদের মধ্যে যে এমন মধ্যমেধার প্রতিভা লুকিয়ে রয়েছে, পুর নিবার্চন না এলে তা বোধহয় ফুটতই না!’’
মোড় ঘুরলেই তাই চোখে পড়ছে—‘বিদ্যালয় ফাঁকি দিয়ে, তুলতে গেলে পদ্ম ফুল/ সাঁইথিয়া যায়নি ভুলে, কুড়োবে তাই জোড়া ফুল’। দু’পা এগোলেই তার পাল্টাও চোখে পড়ছে— ‘জোড়া ফুলের মধু খাও/ পদ্ম ফুলে ভোট দাও’। তরজায় জড়িয়ে পড়েছে কংগ্রেসও। দেওয়াল বলছে— ‘পদ্ম ফুলে কাঁটা আছে, তৃণমূলে আছে কাদা/ ফুট ফুটে দু’টি হাত, শহর হবে চাঁদের হাট’।
মাসখানেক ধরে সাঁইথিয়ার দেওয়ালে দেওয়ালে সেই ছড়া-ফোটা প্রচারের প্রভাবও কম নয়। চায়ের আড্ডা থেকে পুকুরে বাসন মাজার সময়ে আটপৌরে কথোপকথনেও ঢুকে পড়েছে রাজনৈতিক তরজার সেই খই ফোটা ছড়া।
ছড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রয়েছে বিবিধ বাণীও। বাংলা নতুন বছরের ক্যলেন্ডারে ঠাকুরের ছবির তলায় অমৃত বাণীর সঙ্গেই তাই চোখে পড়ছে ফ্লেক্স জুড়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা।
এ ব্যাপারে এগিয়ে রয়েছে সাঁইথিয়ার ৮ নম্বর ওয়ার্ড। চর্তুমুখী লড়াইয়ে সেখানে সামিল তৃণমূলের গোপীনাথ চক্রবর্তী থেকে বিজেপি-র সুশান্ত রায়। অন্তত প্রচারে কম যাচ্ছেন না কংগ্রেসের সুমন দাস এবং নির্দল প্রার্থী চিত্তরঞ্জন মলাকার। এই চর্তুমুখী লড়াইয়ে ওয়ার্ডের কোনও দেওয়ালেই ছড়ার ঘনঘটার কমতি নেই।
বিজেপি-র সুশান্ত রায়ের দেওয়াল যদি বলে, ‘জোড়া ফুলের দিন শেষ, আসছে এ বার পদ্ম-রেশ’, লাগোয়া কোনও দেওয়ালে হয়তো পাল্টা চোখে পড়ছে, ‘পদ্ম থাকে এক দুই মাস, জোড়া ফুল বারোমাস’। আবার তৃণমূলে প্রার্থীর ঘনঘন দল বদলকে কটাক্ষ করে লেখা হচ্ছে, ‘সিংহ ছেড়ে হাত হলে/ নাম লেখালে জোড়া ফুলে/ সাঁইথিয়া কি গেছে ভুলে/ ভোট দিন পদ্মফুলে।’ অথবা ‘হাত ছেড়ে তৃণমূলে, পরে আবার কাদের দলে/ ফিরে এস আমার সাথে, শক্ত কর শহরটাকে হাতে হাতে’। উত্তরও মিলছে, ‘নোটন নোটন পায়রা গুলি জোটন বেঁধেছে/ পুরসভার ভোট ময়দানে নাচতে নেমেছে/ কে দেখেছে কে দেখেছে সবাই দেখেছে/ তাই তো সবাই ভোটটি দেবে জোড়া ফুলেতে’ বা ‘মধু খেয়ে নানা ফুলে বসেছে এবার পদ্ম ফুলে/ আপনার মূল্যবান ভোট তাই এবার দেবেন জোড়া ফুলে’। আবার কোথাও বিজেপি-র পক্ষ থেকে প্রার্থী নোটনকে উদ্দেশ্য করে লেখা, ‘নোটনের হাতে পদ্ম ফুল/এ বার জোড়া ফুল হবে নির্মূল’। তা দেখে হয়তো রাতারাতি তৃণমূল দেওয়াল ভরাচ্ছে, ‘কাঁটা ছিড়ে পদ্ম ফুলে/ ভোট দেবেন জোড়া ফুলে’।
কম যাচ্ছেন না কেউ-ই। কংগ্রেসের সুমন দাস নিজের প্রচারের জন্য লিখেছেন ‘৩০ হাজার ভরি সোনা/ আমার নাম বাবু সোনা/ ভুল করো না ভোট দিতে/ কাজ পাবে হাতে হাতে’ বা ‘তোমরা আমার বড়, আবার সেই ভুল কর/ ফিরতে হবেই হাতে, মনে করে দেখ’।
এক সময় সাঁইথিয়ার নীহার দত্ত ছিলেন বীরভূম জেলা কংগ্রেসের সভাপতি। তাঁর মৃত্যুর পর ছেলেরা শহর কংগ্রেসের দ্বায়িত্ব নিয়েছিলেন। গত পঞ্চায়েত ভোটের আগে সাঁইথিয়াতে তৃণমূলের এক জনসভায় লাভপুরের বিধায়ক মনিরুল ইসলাম নীহার দত্তের বড় ছেলে বাপি দত্তর গলা কেটে নেওয়ার হুমকি দেন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নীহারবাবুর ছোট ছেলে বিপ্লব ও ভাইপো পিনাকীলাল-সহ দত্তবাড়ির অনেকেই যোগ দেন তৃণমূলে। সে কথা মনে করিয়ে দিতে কংগ্রেসের দেওয়াল লিখেছে— ‘শিক্ষা পেলাম দাদুর কাছে/ হাতে ছাপ মারতে/ কাকারা সব উল্টে গেল/ জোড়া ফুল ছাপে-তে’।
হঠাৎ এমন ছড়ার হট্টগোল কেন?
বিজেপি-র সুশান্ত রায়ের ব্যাখ্যা ‘‘আমি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। পড়ানোর ক্ষেত্রে দেখেছি ছোট ছোট ছড়া বাচ্চারা সহজে মনে রেখে দিতে পারে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি এ ভাবে ছড়া দিয়ে দেওয়া লিখন করিয়েছি।’’ কংগ্রেসের সুমন দাসের ব্যাখ্যাটা অবশ্য আলাদা— ‘‘ভোটের আগে আমাদের বহু দেওয়াল বিরোধীরা দখল করে নিয়েছিল। ওদের ক্ষমতার সঙ্গে আমি পেরে উঠতাম না। আর খুব বড় দেওয়াল ফাঁকাও ছিল না। কিন্তু আমাকেও তো প্রচার করতে হবে। তাই ছোট দেওয়ালে এ ভাবেই ছড়া কেটে প্রচার করছি।’’
নির্দল প্রার্থী চিত্তরঞ্জন মালাকার অবশ্য এ ভাবে দেওয়াল লেখায় বিশ্বাসী নন। তিনি বললেন ‘‘এ ভাবে দেওয়াল লিখে ভোটে জেতা যায় না। ভোটাররা যোগ্য প্রার্থীকেই ভোট দেবেন। দেওয়াল লেখা দেখে নয়।’’ বীরভূম জেলা তৃণমূল সম্পাদক দেবাশিস সাহা বলছেন, ‘‘এটাও প্রচারের একটা মাধ্যম। আমরা তা-ই করেছি।’’
ওয়ার্ডের বাসিন্দারা কিন্তু এতে বেশ মজা পেয়েছেন। উৎপল হালদার, সীমা দাস বলছেন, ‘‘একেবারে নতুন রকম। বেশ ভাল লাগছে।’’ দিনভর পরিশ্রম করে দেওয়াল লিখছেন পার্থ মাহারা। তিনি বলেন, ‘‘গত ৭-৮ বছর ধরে ভোটের দেওয়াল লিখছি। ছড়া দিয়ে দেওয়াল লিখন এ বারই প্রথম। একঘেয়েমি কাটছে। বেশ ভালোই লাগছে।’’