ভেসে: গত সপ্তাহের বৃষ্টিতে। পুরুলিয়া শহরের সূর্য সেনপল্লিতে। ছবি: সুজিত মাহাতো
গত ৩০ বছরে এমন অভিজ্ঞতা হয়নি। গত বৃহস্পতিবার সকালে ঘুম ভেঙে ঘরের মধ্যে হাঁটু-জল দেখে তাই চমকে উঠেছিলেন পুরুলিয়া শহরের হুচুকপাড়ার বাসিন্দা সুচন্দ্রা দাস। শুধু হুচুকপাড়া নয়, গত সপ্তাহে দিন দু’য়েকের বৃষ্টিতে নিমটাঁড়, লোকনাথপল্লি, সূর্যসেনপল্লি, অম্বরীশপল্লি, রামপদ কলোনি, ভাগাবাঁধ পাড়া, রথতলা-স্টেশন রোড, নিউ কলোনি-সহ একাধিক এলাকাকে জলমগ্ন হতে দেখেছে শহর। কোথাও হাঁটু, কোথাও কোমর, কোথাও বুক সমান জলে কার্যত খাবি খেয়েছে শহর।
১৯৯২-র বন্যা স্মৃতিতে রেখে শহরের প্রবীণ বাসিন্দা দিলীপকুমার গোস্বামীর কথায়, “সে বারেও এমন টানা বৃষ্টি হয়েছিল। তবে এ ভাবে শহরের বিভিন্ন এলাকা ডোবেনি।”
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২৩৪ মিটার উপরে পুরুলিয়া শহরের অবস্থান। শহরের পাশ দিয়ে কংসাবতী নদী বয়ে গেলেও এমন নয় যে, নদীর জল উপচে শহরের নিচু এলাকা ভাসিয়েছে। তা হলে, দু’দিনের বৃষ্টিতে শহর এ ভাবে জল জমল কেন?
শহরের প্রবীণদের একাংশ জানাচ্ছেন, শহরের ভূমির ঢাল পূব দিকে। বৃষ্টির জল বিভিন্ন এলাকার নিকাশি নালা বেয়ে সে দিকে গড়িয়ে যায়। তবে দীর্ঘকাল ধরে যে সব নিচু এলাকা দিয়ে জল বেরিয়ে যেত, সে সব এলাকায় গত কয়েক বছরে গড়ে উঠেছে একাধিক আবাসন। শহরের চৌহদ্দি বাড়লেও সে নিরিখে নিকাশি ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।
যার ফল, এই বানভাসি অবস্থা। বছর তিনেক আগে পুরসভার তরফেও জানানো হয়েছিল, শহরের নিকাশি ব্যবস্থার কোনও মানচিত্র তাদের কাছে নেই। ইতিউতি দু’-একটি নিকাশি নালা তৈরি হলেও শহরের নিকাশি-ব্যবস্থার পুরনো চেহারার কার্যত কোনও
বদল ঘটেনি।
অন্য সমস্যাও রয়েছে। শহরের অম্বরীশপল্লির বাসিন্দা নিলয় মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “ফুটপাতের দখলদারি নিকাশি নালা পর্যন্ত পৌঁছছে। কী ভাবে বৃষ্টির জল বেরোবে!” পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের পুরুলিয়া জেলা সম্পাদক তথা চিকিৎসক নয়ন মুখোপাধ্যায়ও বলেন, “বৃষ্টির জল শহরের বিভিন্ন এলাকার পুকুরগুলিতে জমা হয়। তবে সে সব পুকুরগুলির গভীরতা কমেছে। এ দিকে, শহরের যে সব নিচু এলাকা দিয়ে আগে বৃষ্টির জল বেরিয়ে যেত, সেখানে ঘরবাড়ি তৈরি হয়েছে। সে সব ক্ষেত্রে নিকাশি ব্যবস্থায় যে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল, তা হয়নি। নিকাশি নালাগুলিও প্লাস্টিক, থার্মোকলে বুজে থাকে।” তাঁর সংযোজন, “শুধু পুরসভার দিকে আঙুল তুললে হবে না। নাগরিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। এক দিকে, প্লাস্টিক ব্যবহারের বিপক্ষে কথা বলব, আর অন্য দিকে, যত্রতত্র প্লাস্টিক ফেলব, এই দ্বিচারিতা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।”
প্রচণ্ড বৃষ্টি হয়েছে ঠিকই, তবে বর্ষার আগে শহরের প্রধান নিকাশি নালাগুলি সংস্কার করা হলে, হয়তো এতটা জল জমত না, মত শহরের প্রাক্তন পুরপ্রধান সামিমদাদ খানের।
শহরের আর এক প্রাক্তন পুর-প্রধান বিনায়ক ভট্টাচার্যেরও মন্তব্য, “এটা ঘটনা যে, অপরিকল্পিত ভাবে শহর বেড়েছে। নিকাশির বিষয়টিকে সে ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বরাবর আমরা পানীয় জল নিয়েই ভেবেছি। এ বারে মনে হয়, নিকাশির নিয়েও নতুন করে ভাবার সময় এসেছে।”
পুরসভার বর্তমান বিরোধী দলনেতা তথা পুরুলিয়ার বিধায়ক সুদীপ মুখোপাধ্যায়ও নিকাশি নালা দখল হওয়ার দিকে আঙুল তুলছেন। তাঁর কথায়, “শহরের প্রাণকেন্দ্র ট্যাক্সিস্ট্যান্ড এলাকায় আগে যতগুলি নিকাশি নালা ছিল, আজ তার কয়েকটির অস্তিত্বই নেই। নিকাশি নালার উপরে কংক্রিটের নির্মাণ গড়ে ওঠায় নালা সাফাই করা যায় না।”
তাঁর আরও অভিযোগ, “আসলে নিকাশি সম্পর্কে কোনও নির্দিষ্ট তথ্যই পুরসভার কাছে নেই। কোনও পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলেও জানি না। ফলে, যা হওয়ার তাই হয়েছে।”
নিকাশি-সমস্যা মেনে পুর-প্রশাসক নবেন্দু মাহালি বলেন, “এটা ঘটনা যে, শহরের পুকুরগুলির গভীরতা কমে গিয়েছে। ফলে, প্রবল বৃষ্টিতে জল উপচে রাস্তায় উঠেছে। একাধিক এলাকায় জল জমেছে। ঘরেও জল ঢুকেছে। শহরের নিকাশির গোটা বিষয়টি আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। বাড়ি তৈরির অনুমতি দেওয়ার আগে এ বিষয়গুলি বিবেচনায় রাখা হবে।” (চলবে)