(বাঁ দিকে) নদীর বালির চরে মুদ্রার খোঁজ, (ডান দিকে) এমনই মুদ্রা মিলেছে বলে দাবি। নিজস্ব চিত্র
বালি খুঁড়লেই না কি মিলছে সোনার মুদ্রা! এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়তেই বিভিন্ন গ্রামের মানুষজন সোনার মুদ্রা খুঁজতে ভিড় জমাচ্ছেন মুরারই থানার পারকান্দি গ্রামের পাশে বাঁশলৈ নদীতে।
এলাকাবাসীর একাংশের দাবি, দিন দুয়েক আগে নদী থেকে বালি তুলতে গিয়ে কয়েক জন সোনার মুদ্রা পেয়েছিলেন। সে খবর, চাউড় হতেই কয়েক’শো বাসিন্দা নদীতে সোনার মুদ্রা খুঁজতে শুরু করেন। অনেকে পেয়েছেন। আবার অনেকে খালি হাতে ফিরেছেন। বৃহস্পতিবার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, তখনও অনেকে সোনার মুদ্রার খোঁজ চালাচ্ছেন। হাতে বালি ও মাটি তোলার সামগ্রী। অনেকে নদীর ভিতর থেকে বালি তুলে এনে দেখছেন সোনার মুদ্রা আছে কি না। তবে দশটার পরে পুলিশ-প্রশাসন গিয়ে জায়গাটি ঘিরে দেন। যাঁরা নদীতে ছিলেন তাঁদের সরিয়ে দেওয়া হয়। যে একশো মিটার জুড়ে সোনার মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে বলে দাবিস সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক সুতপা সিংহ বলেন, ‘‘উক্ত স্বর্ণমুদ্রাগুলি ওড়িশার পূর্ব গঙ্গ বংশীয় কোনও রাজার। এঁরা প্রাচ্য গঙ্গো নামেও পরিচিত ছিলেন। বর্তমান সমগ্র ওড়িশা রাজ্য, ছত্তীসগঢ় ও কর্নাটকের কিছু অংশ এবং দক্ষিণবঙ্গের কয়েকটি জেলা সার্বভৌম পূর্ব গঙ্গ রাজাদের শাসনাধীন ছিল খ্রিস্টীয় একাদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত। এই অঞ্চল কলিঙ্গ দেশ নামেই সমধিক পরিচিত। পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দির এবং কোনারকের সূর্যমন্দির গঙ্গো বংশের রাজা দের দ্বারা নির্মিত।’’
সুতপা বলেন, ‘‘রামপুরহাট মহকুমায় নদীর পাড়ে থেকে পাওয়া এই স্বর্ণমুদ্রাগুলিকে ‘ফনম’ বলা হয় এবং সাধারণ ভাবে এগুলির ওজন আধ গ্রামের ও কম হয়। ব্যাস মাত্র ০.৫ থেকে ০.৮ মিলিমিটার এর মধ্যে। মুদ্রার মুখ্য দিকে একটি মাটিতে উপবেশনরত ষাঁড়ের প্রতিকৃতি দেখা যায়, সঙ্গে অন্য কোনও চিহ্ন। গৌণ দিকে, একটি ‘স’ অক্ষর লেখা থাকে, সঙ্গে অঙ্কুশ বা ত্রিশূল। এর নীচে থাকে একটি সংখ্যা যা রাজত্বের বছর নির্দেশ করে। এঁরা অঙ্ক পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। প্রাপ্ত মুদ্রা তিনটিতে ‘৫’ সংখ্যা উৎকীর্ণ আছে বলে মনে হয়। এখনও পর্যন্ত কোনও মুদ্রাতত্ত্ববিদ কোন মুদ্রা কোন রাজা জারি করেছিলেন, এই বিষয়ে আলোকপাত করতে সক্ষম হননি তবে সাম্প্রতিক গবেষণায় পঙ্কজ ট্যান্ডন রাজা অনন্ত বর্মন চোড়গঙ্গ দেবের মুদ্রা সনাক্ত করণের চেষ্টা করেছেন এবং সমগ্র ‘ফনম’ মুদ্রার একটি শ্রেণি বিভাগ করেছেন। সেই হিসেবে বর্তমান মুদ্রাগুলি পঞ্চদশ শতকের চতুর্থ ভানুদেবের (১৪১৪-৩৪ খ্রিস্টাব্দের) বলে চিহ্নিত করা যেতে পারে। বঙ্গে সেই সময় সুলতান জালালউদ্দিন মোহাম্মদ শাহ রাজত্ব করতেন এবং কলিঙ্গ রাজাদের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেনের কারণে হয়তো এই স্বর্ণমুদ্রাগুলি বীরভূম অঞ্চলে এসে থাকতে পারে।’’
রাজীব মাল,লোটন মাল ও জয়দেব মালের মতো কয়েক জন মুদ্রা পেয়েছেন। তাঁরা বলেন, ‘‘নদীতে বালি খুঁড়তেই সোনার টিকলির মত ছোট ছোট মুদ্রা পেয়েছি। তিন জন ন’টি মুদ্রা পেয়েছি। এ দিন মুরারই থানার পুলিশ মুদ্রাগুলি থানায় জমা দিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে। প্রাচীন মুদ্রা হওয়ায় এই নির্দেশ। পুলিশ-প্রশাসনের নির্দেশ মতো মুদ্রাগুলি থানায় জমা দিয়ে যাব।’’ বাসিন্দাদের একাংশ জানান, প্রাচীন মুদ্রা ও মূর্তি সংগ্রহের ব্যবস্থা করতে হবে প্রশাসনকে।। মুরারই ছাড়াও নলহাটি ১ ও ২ ব্লকেও অনেক সময় বাড়ি তৈরি, পুকুর কাটতে গিয়ে প্রাচীন মূর্তি ও মুদ্রা পাওয়া যায়। এ ঘটনা বেশ কয়েক বার ঘটেছে। এ সব নিয়ে একটি সংগ্রহশালা তৈরি জরুরি।
এ প্রসঙ্গে রামপুরহাটের মহকুমাশাসক আব্বাস নাভাস বলেন, ‘‘বিষয়টি নজরে এসেছে। পুলিশ-প্রশাসনকে মুদ্রাগুলি সংগ্রহ করার জন্য বলা হয়েছে।’’ বীরভূমের পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘জায়গাটি পুলিশ-প্রশাসন ঘিরে রেখেছে। সোনার মুদ্রা খুঁজতে মানুষজন ভিড় জমাচ্ছেন। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতেই এই পদক্ষেপ।’’