মাঠ ভরা পাকা ধান। মজুর নেই। ওন্দার আইলঠ্যায় তোলা নিজস্ব চিত্র।
মাঠ ভরা পাকা ধান। অথচ ঘরে তোলার উপায় নেই! খুচরো টাকার অভাবে কৃষকদের ঘরে-ঘরে এখন হাতটান। ফলে পাকা ফসল তুলতে জনমজুরদের মাঠে নামাতে পারছেন না চাষিরা। আবার কাজ না পেয়ে দিন আনা দিন খাওয়া শ্রমিকদের মাথায় হাত পড়েছে। সব মিলিয়ে কৃষিকাজকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া দুই জেলার গ্রামীণ অর্থনীতির গতিতেও ছেদ ফেলেছে কেন্দ্রের নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত।
বাঁকুড়া জেলা কৃষি দফতর জানাচ্ছে, নভেম্বরের মাঝামাঝি এই জেলায় মাঠে থাকা আমন ধানের অন্তত ৩০ শতাংশই ঘরে তুলে নেন চাষিরা। শুরু হয়ে যায় আলুর বীজ বপনের কাজও। তবে এ বার পরিস্থিতি আলাদা। হাতে নগদ টাকার জোগানের অভাবে ধান কাটার গতি কমেছে অন্তত ১০ শতাংশ। জেলা উপকৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) আশিস বেরার কথায়, “১০০০ টাকা ও ৫০০ টাকা নোট বাতিল হয়ে যাওয়ার প্রভাব জেলার চাষিদের উপরে পড়েছে। ধান কাটার গতিও কমেছে। কবে সাধারণ মানুষের হাতে জনমজুরদের মজুরি দেওয়ার মতো নগদের জোগান বেড়ে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হয়, সে দিকেই তাকিয়ে রয়েছি আমরাও।”
ওন্দার আইলঠ্যা গ্রামের চাষি রবি বারিক পাঁচ বিঘা জমিতে আমন ধান লাগিয়েছিলেন। এ বার তাঁর ফলন হয়েছে বেশ ভালই। ধান পেকে গিয়ে তোলার মতো অবস্থায় এসে গিয়েছে বেশ কয়েক দিন আগেই। কিন্তু ধান কাটাতে পারছেন না তিনি। রবিবাবুর কথায়, “ব্যাঙ্কে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়েও পর্যাপ্ত টাকা তুলতে পারছি না। যতটুকু টাকা হাতে এসেছে, তা সংসার খরচেই বেরিয়ে যাচ্ছে। শ্রমিক লাগিয়ে ধান কাটাবার মতো টাকা কোথায়? খুব সমস্যায় পড়ে গিয়েছি।” তিনি জানাচ্ছেন, জমির ধান যে পর্যায়ে রয়েছে, তাতে করে বেশিদিন ফেলে রাখাও ঠিক হবে না। তাই হাতে টাকা না এলে কিছু দিনের মধ্যে বাধ্য হয়ে নিজেই ধান কাটতে নামবেন বলে ঠিক করেছেন তিনি।
অন্যদিকে, ওন্দার রামসাগর সংলগ্ন লাপুড় গ্রামের কৃষক আশিস দে ৩২ বিঘা জমিতে আমন ধান চাষ করেছেন এ বার। তাঁরও জমির ধান তোলার মতো অবস্থায় এসে গিয়েছে। তবে হাতে টাকার জোগান কম হওয়ায় শ্রমিক লাগাতে পারছেন না। ধারে ধানকাটা মেশিন ভাড়া করে নিয়ে এসে কিছুটা জমির ধান কাটিয়েছেন তিনি। আশিসবাবুর কথায়, “হাতে টাকা নেই বলেই শ্রমিক লাগাতে পারছি না। কারণ শ্রমিকেরা ধার বিশেষ ফেলে রাখতে চান না। তাই বাধ্য হয়েই ধার করে মেশিন ভাড়া করে এনে ধান কাটাতে হচ্ছে।” তাঁর আক্ষেপ, অন্যান্য বছরে এই সময়ে মাঠের ধান তুলে নিয়ে আলু বীজ লাগানোর কাজ সেরে ফেলেন তিনি। তবে এ বার ছন্দপতন ঘটেছে হাতে নগদ টাকার অভাবে।
পুরুলিয়া জেলাতেও বেশিরভাগ কৃষকের হাতে এখনও পর্যন্ত নতুন নোট আসেনি। পুরনো নোট রয়েছে। কেউ কেউ ইতিমধ্যে ব্যাঙ্কে জমা করেছেন। কিন্তু টাকা তুলতে হিমশিম অবস্থা তাঁদের। বোরো থানার মলিয়ান গ্রামের বাসিন্দা হংসেশ্বর মাহাতো মানবাজার ২ ব্লকের তৃণমূলের সভাপতি। তাঁর কথায়, ‘‘ধান বিক্রির টাকায় অনেক খরচ সামলাই। কিন্তু এ বার খুচরো টাকার অভাবে জনমজুরদের ধান কাটতে নামাতে পারছি না। কী করব ভেবে পাচ্ছি না।’’
একই সমস্যায় বান্দোয়ানের ধবনি গ্রামের সম্পন্ন চাষি জগদীশ মাহাতোও। তিনি বলেন, ‘‘শ্রমিকরা বড় নোট নিতে চাইছেন না। ১০০ টাকার নোটও তেমন হাতে নেই। পরে মজুরির টাকা দেব বলে দু’দিন শ্রমিকরা ধান কেটেছেন। শীঘ্রই নতুন খুচরো নোটের আমদানি না হলে খুব বিপদে পড়ে যাব।’’
খেতমজুরদের রুটি-রুজিতেও টান পড়েছে। মানবাজার থানার ঝাড়বাগদা গ্রামের কৃষি শ্রমিক দম্পতি রেণুকা মাঝি ও সন্তোষ মাঝি এক কৃষকের জমিতে তিনদিন ধান কেটেছেন। ১৫০ টাকা হিসাবে তিনদিনের মজুরি বাবদ তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর প্রাপ্য ৯০০ টাকা। সন্তোষবাবু বলেন, ‘‘জমির মালিক ১০০০ টাকার নোট দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ওই টাকা তো এখন চলছে না। তাই নিইনি। এ দিকে টাকার অভাবে সংসার টানাও মুশকিল হয়ে পড়েছে।’’
ওন্দার গোলদারপাড়া এলাকার খেত মজুর রামবিলাস রায় জানান, “দু’দিন একদিন ছাড়া ধান কাটার কাজ পাচ্ছি। তাও আবার বেশির ভাগটাই ধারে ফেলে রাখতে হচ্ছে। আমাদের চলবে কী ভাবে?’’
নগদ টাকার জোগানের অভাবে শুধু যে ধান কাটা যাচ্ছে না তাই নয়, সব্জি চাষেও এর প্রভাব পড়েছে। ওন্দার পিংরুই গ্রামের চাষি সত্যকিঙ্কর কর্মকার এক বিঘা জমিতে ফুলকপি ও বাঁধাকপি লাগিয়েছেন। তিনি জানাচ্ছেন, প্রতি সপ্তাহে জমিতে কমবেশি ৪৬০ টাকার কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয় ফসলে রোগ পোকার আক্রমণ ঠেকাতে। হাতে টাকার জোগান কম হয়ে পড়ায় আপাতত দোকান থেকে ধারে কীটনাশক কিনছি। এ দিকে ব্যাঙ্কে গিয়েও চাহিদা মতো টাকা তুলতে পারছি না। এই রকম বেশি দিন চললে বিপদে পড়ব।”
নোট-সঙ্কটে গ্রাম-বাংলার মানুষের হাতে টাকার লেনদেন কমে যাওয়ায় স্থানীয় দোকান, বাজার, হাটেও এর প্রভাব পড়েছে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন, গৃহস্থালী জিনিসের বিক্রিবাটা বেশ কমে গিয়েছে। তাই তাঁরাও দোকানে কম মাল তুলছেন।