পরিকাঠামোর তেমন বদল হয়নি। নাম পাল্টে চালু বীরভূমের সব চেয়ে নতুন থানা। —ফাইল চিত্র।
ছিল রুমাল, হয়ে গেল একটা বেড়াল!
না, সুকুমার রায়ের ‘হ য ব র ল’ নয়। এই কাহিনি ঘোর বাস্তবের। যার কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে বিশ্বভারতীর লিজ দেওয়া জমিতে গড়ে ওঠা শান্তিনিকেতন তদন্ত কেন্দ্র। বস্তুত, গত ১৮ সেপ্টেম্বর সকালেও যেটি ছিল তদন্ত কেন্দ্র, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই রাতারাতি হয়ে উঠল আস্ত একটি থানা!
আর তার পরেই ক্ষোভ তৈরি হয়েছে এলাকাবাসীর মধ্যে। যে দাবি ছিল দীর্ঘ দিনের, তা কেন অসম্পূর্ণ ভাবে পূরণ করা হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে এখনই। তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, উপযুক্ত পরিকাঠামো না গড়ে, শুধু নাম পরিবর্তন করলেই থানা গড়া যায় না। তড়িঘড়ি উদ্বোধন না করে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো যুক্ত করে তবেই শান্তিনিকেতন থানা তৈরি করা দরকার ছিল বলেই স্থানীয় বাসিন্দাদের মত। এই পরিস্থিতিতে জেলার পুলিশ-প্রশাসনকেই দুষছেন বিরোধীরা। তাঁদের দাবি, ‘‘স্থানীয় বাসিন্দাদের দীর্ঘ দিনের দাবি নয়। মুখ্যমন্ত্রীকে খুশি করাই এখন প্রশাসনের একমাত্র উদ্দেশ্য। তাই প্রয়োজনীয় কিছু না দিয়েই ধুঁকতে থাকা একটা তদন্ত কেন্দ্রকে রাতারাতি থানায় রূপান্তরিত করে দেওয়া হল!’’ জেলার পুলিশ সুপার যদিও ওই বক্তব্য মানতে চাননি। তাঁর সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা, ‘‘আস্তে, আস্তে সব হবে। প্রথমে কিছু সমস্যা হবে ঠিকই। তবে, আগামী দিনে বাসিন্দারা ভাল পরিষেবা পাবেন।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের খবর, এলাকার গুরুত্ব উপলব্ধি করে বোলপুর থানা এলাকার মধ্যে থাকা শান্তিনিকেতনে একটি তদন্ত কেন্দ্র গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সেই অনুযায়ী, ১৯৮৩ সালে বিশ্বভারতীর কাছ থেকে লিজে পাওয়া একটি জমিতে গড়ে ওঠে শান্তিনিকেতন তদন্ত কেন্দ্র। শান্তিনিকেতনের মতো একটি আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্রের কালে কালে আরও গুরুত্ব বেড়েছে। প্রতি দিন দেশিবিদেশি পর্যটকদের আনাগোনা রয়েছে। পাশাপাশি বহু দেশের ছাত্রছাত্রী এখানে পঠনপাঠন করেন। বিশ্বভারতীর নিজস্ব নিরাপত্তা বিভাগ থাকলেও এলাকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপত্তার জন্য সেই আয়োজন যথেষ্ট নয়। তাই শান্তিনিকেতন এবং পারিপার্শিক কিছু এলাকার জন্য পৃথক একটি থানা গড়ার দাবি উঠছিল দীর্ঘ দিন ধরেই। এ দিকে, এলাকা চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, খুনের মতো অপরাধের পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা ক্রমশ বেড়েই চলেছে। প্রয়োজনীয় এবং উপযুক্ত পরিকাঠামো দিয়ে শান্তিনিকেতন তদন্ত কেন্দ্রকে থানায় উত্তীর্ণ করার জন্য সম্প্রতি দাবি আরও জোরাল হচ্ছিল। তার পরেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্বাস মতো গত সপ্তাহেই পুলিশের রবীন্দ্রসঙ্গীত সহযোগে ‘তদন্ত কেন্দ্র’ লেখা মুছে ‘শান্তিনিকেতন থানা’র উদ্বোধন হয়।
ঘটনা হল, থানা হওয়ার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো না গড়েই শান্তিনিকেতন থানা চালু করে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাসিন্দাদের তোলা ওই অভিযোগ জেলা পুলিশের কর্তাদের একাংশ আড়ালে মেনেও নিচ্ছেন। যখন তদন্ত কেন্দ্র ছিল, তখন সেখানে এক জন সাব-ইনস্পেক্টর, ৪ জন এএসআই (এক জন মহিলা), ১৪ জন কনস্টেবল, এক জন হোমগার্ড, এক জন এনভিএফ কর্মী ছিলেন। আর থানা হওয়ার পরে দু’ জন সাব ইনস্পেক্টর (এক জন এখনও কাজে যোগ দেননি), দু’ জন এএসআই, ১৮ জন কনস্টেবল, এক জন হোমগার্ড, এক জন এনভিএফ কর্মী রয়েছেন এবং ৫০ জন সিভিক ভলান্টিয়ার। পুলিশ লকআপ বলতে যা বোঝায়, তা নেই। দরজাহীন একটি ঘরকে আপাতত হাজত হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, ‘‘যে কোনও থানায় কম করে তিন জন সাব ইনস্পেক্টর, ৮-৯ জন এএসআই, ২০ জন কনস্টেবল, ৪ হোমগার্ড, ৪ জন এনভিএফ কর্মী থাকার কথা। থানায় মহিলা এএসআই এবং সাব-ইনস্পেক্টর থাকবেন বটে। কিন্তু, জেলায় তাঁদের সংখ্যা কম (৪ সাব-ইনস্পেক্টর, ৫ এএসআই) রয়েছে। সেই অনুপাতে তাঁরা থাকবেন।’’
এ ক্ষেত্রে ঠিক পাশেই থাকা বোলপুর থানার ছবিটা কেমন? পুলিশ সূত্রের খবর, ওই থানায় বর্তমানে এক জন ইনস্পেক্টর, চার জন সাব-ইনস্পেক্টর, ৬ জন এএসআই (দু’জন মহিলা), ১৮ জন কনস্টেবল, চার জন হোমগার্ড, চার জন এনভিএফ কর্মী এবং ১৫০ সিভিক ভলান্টিয়ার রয়েছে। সে সংখ্যাও যথেষ্ট কম বলেই মনে করছেন জেলার পুলিশ কর্তারা। ফলে রাতারাতি থানা উদ্বোধন নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই ক্ষুব্ধ বাসিন্দারা। গত জুলাইয়ে পশ্চিম গুরুপল্লিতে বিশ্বভারতীর কর্মী রবীন্দ্রনাথ ঘোষের বাড়িতে ডাকাতি হয়েছিল। সেই ঘটনার কিনারা আজও হয়নি। তিনি বলছেন, ‘‘আমার অভিজ্ঞতা বলছে, শুধু অভিযোগ নিয়েই ওরা কাজ সারবেন। পরিকাঠামো তো সেই একই রয়েছে। তা হলে পরিষেবার ছবিটা কি বদলাবে?’’ একই ভাবে সীমান্ত পল্লির মনোজ দাসের বাড়ির চুরির ঘটনাও আজও কিনারা হয়নি। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘এলাকায় ক্রমাগত চুরি বাড়ছে। কোনও ব্যবস্থায় হচ্ছে না। তদন্ত কেন্দ্রই হোক না থানা, ন্যনতম পরিষেবা না মিললে কোনও কিছুরই কোনও মানে হয় না।’’
বাসিন্দাদের ক্ষোভকে ন্যায্য বলেই দাবি বিরোধী দলগুলির। বোলপুরের প্রাক্তন সাংসদ তথা সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি সদস্য রামচন্দ্র ডোম যেমন বলছেন, “এটা চমক ছাড়া কিছুই নয়। থানার সংখ্যা বাড়িয়ে আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও নিয়ন্ত্রণ করা যায় ঠিকই। কিন্তু, তা তো পরিকল্পনা মাফিক করতে হবে! লোকবল নেই, পরিকাঠামো নেই! দুম করে থানার উদ্বোধন করে দেওয়া আসলে জনতার চোখে ধুলো দেওয়া।’’ অন্য দিকে, জেলা বিজেপির সভাপতি অর্জুন সাহার বক্তব্য, “রাজ্যেজুড়ে খালি উদ্বোধন আর ঘোষণা। শান্তিনিকেতনও বাদ যাবে কেন! পরিকাঠামোই নেই অথচ থানা উদ্বোধন করা দেওয়া হল। কাগজে-কলমে খালি থানার সংখ্যা বাড়ালেই হবে? আসল দরকারের জিনিসটা হল, মানুষের নিরাপত্তা। সেটুকু আগে দিক, তা হলেই হবে।’’ অন্য দিকে, এই সরকার স্থায়ী সম্পদ গড়ার বদলে খুচরো চমকেই ভোটব্যাঙ্ক ধরে রাখার ছক করছে বলে অভিযোগ জেলা কংগ্রেস সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মির। তাঁর কটাক্ষ, ‘‘যে দিন পুলিশের বড় কর্তার সামনে রবীন্দ্রসঙ্গীত আর তবলা সঙ্গতে ওই থানার উদ্বোধন হচ্ছিল, ঠিক তখনই জেলার আর এক থানা কাঁকরতলায় পুলিশকে পিটিয়ে তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা অপরাধীকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল! ওই থানায় তা-ও লোকবল ছিল। শান্তিনিকেতনে তো কিছুই নেই শুনছি। পুলিশ কর্মীরা নিরাপদ থাকবেন তো?’’
স্বাভাবিক ভাবেই বিরোধীদের দাবি মানছে না শাসকদল এবং জেলা প্রশাসন। থানার উদ্বোধনে হাজির তৃণমূল নেতা তথা জেলার সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীর যদিও দাবি, ‘‘কোনও সমস্যা হবে না। এলাকার মানুষ নতুন শান্তিনিকেতন থানা থেকে সব রকমের আইনশৃঙ্খলা, নিরাপত্তা বিষয়ক সুবিধা সুযোগ এখানে পাবেন।” একই সুরে জেলাশাসক পি মোহন গাঁধী বলছেন, “নতুন থানা এলাকার বাসিন্দাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা করবে। খয়রাশোল, রাজনগর, শান্তিনিকেতনের মতো তারাপীঠ, মুরারই-সহ আরও বেশ কয়েকটি জায়াগায় নতুন থানার আর্জি রয়েছে। রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরে সেই প্রস্তাব পাঠানোও হয়েছে। খুব শীঘ্রই ব্যবস্থা হবে।”