রাতটাকে যে দিন করেছে: ঝলমল করছে পাড়। জলেও জ্বলছে আলো। সাহেববাঁধ পর্যটকদের মন কাড়লেও পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা কমেছে। ছবি: সুজিত মাহাতো
কচুরিপানা সরানো হয়েছে। আগের থেকে স্বচ্ছতা ফিরেছে জলে। কিন্তু পরিযায়ী পাখিদের মন ফিরে পায়নি পুরুলিয়ার সাহেববাঁধ। জাতীয় সরোবরের মর্যাদা পাওয়া এই সরোবরে এ বার শীতের অতিথিদের অভাব যন্ত্রণা দিচ্ছে প্রকৃতিপ্রেমীদের। তাঁদের আক্ষেপ, বছরের পর বছর ধরে লাগামহীন দূষণেই পরিযায়ী পাখিরা ধীরে ধীরে সাহেববাঁধ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।
প্রবীণেরা জানাচ্ছেন, একটা সময়ে সাহেববাঁধকে ঘিরে নির্মল পরিবেশ ছিল। তাই এই জলাশয়কে ডাকা হয় ‘শহরের ফুসফুস’ নামে। ফাঁকা ছিল বাঁধের পাড়। শীত এলেই শীতের দেশ থেকে উড়ে আসত ঝাঁক ঝাঁক পাখি। সময় যত গড়িয়েছে, বাঁধকে ঘিরে বেড়ে উঠেছে বহুতল, জলে এসে মিশেছে নর্দমার নোংরা জল। কাটা পড়েছে পাড়ের গাছ।
গড়ে ওঠে ‘সাহেববাঁধ বাঁচাও কমিটি’। বছর দশেক আগে ‘ন্যাশনাল লেক কনজারভেশন দফতর’ এই সরোবরকে জাতীয় সরোবরের মর্যাদা দেওয়ার পরেই এই বাঁধকে দূষণ থেকে রক্ষা করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়। বাঁধের মাটি তোলা হয়। বন্ধ করা হয় বিসর্জন, জামা-কাপড় কাচা। সরানো হয় কচুরিপানাও। পুরসভা ধাপে ধাপে বাঁধকে নতুন চেহারা দেয়। তাতেই প্রশ্ন উঠেছে।
পুরপ্রধান শামিমদাদ খান দাবি করছেন, ‘‘আগে কোনওদিন সাহেববাঁধকে সম্পূর্ণ ভাবে কচুরিপানা মুক্ত করা যায়নি। আমরা বাঁধ থেকে প্রায় সব পানা সরিয়েছি। বছরভর পর্যটক আসে বলে সাহেববাঁধে শিকারা চালু করা হয়েছে। নগর বিনোদন বনায়ন বিভাগের আওতায় গ্রিনসিটি মিশন বাঁধের সৌন্দর্যায়নের কাজ করছে। পাড়ে লাগানো হয়েছে আলো। বাঁধের পাশে বেড়া দেওয়ার কাজ চলছে।’’ নগর বিনোদন বনায়ন বিভাগের তরফে পুরুলিয়া নেতাজি সুভাষ উদ্যানের দায়িত্বে থাকা আধিকারিক বিতান দে জানান, সাহেববাঁধে নর্দমার জল ফেলা বন্ধ করা হয়েছে। গোটা সরোবরকে এমন ভাবে ঘিরে ফেলা হচ্ছে নোংরা জল আর ঢুকতে পারবে না। পর্যটনের প্রসারের কথা ভেবে বাঁধের পাড়ে রেস্তরাঁ তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে।’’
তাতে না হয় পর্যটকদের মন ভরবে, কিন্তু পরিযায়ী পাখিদের মন কি গলবে? প্রশ্ন করছেন ‘পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ’-র জেলা সম্পাদক নয়ন মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘এতে হয়তো জলের দূষণ ঠেকানো যাবে। কিন্তু যে ভাবে বাঁধকে ঘিরে আলো লাগানো হয়েছে, নির্মাণ বাড়ছে, পাড় দিয়ে গাড়ি যাতায়াতে শব্দ দূষণ বেড়ে চলছে— তাতে ‘ইকো সিস্টেম’ ব্যাহত হচ্ছে! তাই পরিযায়ীরা আসছে না।’’
বাঁধের পাড়েই জেলা বিজ্ঞান কেন্দ্র। সেই কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক ধ্রুবজ্যোতি চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এক সময়ে সাহেববাঁধ এত পাখি আসত যে মেলা বসে যেত। কিন্তু দূষণ ও চোরাশিকারিদের উপদ্রবে পাখিরা আসা বন্ধ করে দিয়েছে। তার উপরে বাঁধের পরিবেশই গত ক’বছরে আমূল বদলে গিয়েছে। এ সব মানুষের জন্য দৃষ্টিনন্দন হলেও পাখি বা জলের প্রাণীদের নিরাপদ নয়।’’
তবে কি শীতের অতিথিরা আর ফিরবে না? বিষন্ন শীত শেষের সাহেববাঁধ।