সালুঞ্চি গ্রামের মেলা প্রাঙ্গণ হয়ে স্নান করাতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মনসার শিলামূর্তি। সোমবার।
মনসা পুজো এবং সেই পুজো উপলক্ষে মেলা। বীরভূমে এমনটা হয় বহু এলাকাতেই। কিন্তু, গ্রামের শতাব্দী প্রাচীন মনসা পুজো ও মেলা সফল করতে একজোট হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়, এমনটা খুব বেশি দেখা যায় না। এমন সম্প্রীতির নজির মেলে দুবরাজপুরের সালুঞ্চি গ্রামে। সম্প্রীতির ওই মেলা সোমবার বিকেলে উদ্বোধন করেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি কাজল শেখ।
দুবরাজপুরের যশপুর পঞ্চায়েতের সালুঞ্চি গ্রামটি আদতে তিনটি পাড়া নিয়ে গঠিত। বড় সালুঞ্চি, ছোট সালুঞ্চি এবং পরতপুর। এলাকায় বসবাস পাঁচশোরও বেশি মুসলিম পরিবারের। হিন্দু পরিবারের সংখ্যা কমবেশি ১৮০টি। ভাদ্র মাসের শেষ দিন সোমবার ছিল পরতপুরের সূত্রধরদের শতাব্দী প্রাচীন মনসা (শিলামূর্তি) পুজো। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বহুকাল থেকে এই পুজো ও মেলা আয়োজনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে উভয় সম্প্রদায়। হিন্দু-মুসলিম, প্রতিটি পরিবারে আত্মীয়-পরিজনের ভিড়। নতুন পোশাকের গন্ধ। বাইরে কর্মরতরা গ্রামে ফেরেন এই সময়, গ্রামের অন্যতম প্রধান উৎসবের টানে ফেরেন বিবাহিত মেয়েরাও।
বংশ পরম্পরায় পুজোর দায়িত্বে থাকা পরিবারের সদস্য জগন্নাথ সূত্রধর, নিরঞ্জন সূত্রধর, বিপত্তারণ সূত্রধরেরা বলেন, ‘‘গ্রামের একটি পুকুর থেকে মায়ের (মনসা) শিলামূর্তি উঠেছিল। ঠিক কবে থেকে আমাদের পুর্বপুরুষরা পুজোর আয়োজন করেছেন, বলতে পারব না। কিন্তু প্রথম থেকেই গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এই পুজোর সঙ্গে জুড়ে।’’ জগন্নাথের কথায়, ‘‘আমাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ। কার্যত চেয়েচিন্তে পুজোর খরচ উঠে। গ্রামের সকল মুসলিম পরিবার সাধ্যমতো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।’’
ওই এলাকা থেকে নির্বাচিত দুবরাজপুর পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য মহম্মদ জসিমউদ্দিন, স্থানীয় বাসিন্দা শেখ মিঠুরা বলছেন, ‘‘আমাদের গ্রামের অন্যতম প্রধান উৎসব এটি। সকলেই মিলিত ভাবে চেষ্টা করি, যাতে কোথাও যাতে খামতি না থাকে।’’ গ্রাম সূত্রে খবর, আগে তিনটি পাড়ায় মনসা পুজোর সময় যাত্রার আয়োজন করতেন মুসলিম যুবকেরা। গত কয়েক বছর ধরে সেটা বন্ধ। তবে মনসা পুজো, মনসামঙ্গল গান, মেলা প্রাঙ্গণের মঞ্চে লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান, তিন দিনের মেলা, উদ্দীপনা সবই এক আছে। গ্রামের প্রৌঢ়া তাঞ্জিলা বিবি, যশপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রাক্তন প্রধান কামরুন্নেসা বেগম জানালেন, প্রতি পরিবারে আত্মীয়।
পুজো ও মেলার টানে আশপাশের গ্রামের শ্বশুরবাড়ি থেকে সবিতা সূত্রধর, দীপালি বগদিরা গ্রামে ফিরেছেন। সেই একই টানে খয়রাশোলের নওপাড়া শ্বশুরবাড়ি থেকে গ্রামে এসেছেন মনিকা বিবি। পাশের সেকান্দারপুরের শ্বশুরবাড়ি থেকে ফিরেছেন আজমিরা বিবি। সকলেই বলছেন, ‘‘এই সময়টা অন্য সকলের সঙ্গে দেখা হয়। আনন্দে কাটে। তাই কোনও বছর বাদ দিই না।’’ এই সম্প্রীতিই সালুঞ্চি গ্রামের জোর—একবাক্যে মানছেন সবাই। প্রৌঢ় শেখ খেলাফৎ বলছেন, ‘‘আমাদের গ্রামে কোনও বিভেদ নেই। সকলে একজোট। হিন্দুরা আমাদের পরবে যোগ দেয়, আমরা দুর্গাপ্রতিমা কাঁধে নিই। বিপদ আপদে একে অন্যের পাশে থাকি।’