রেখা খাতুন। নিজস্ব চিত্র
এমনিতেই কোনও মায়ের পক্ষে একক ভাবে সন্তানকে বড় করে তোলা কম নয়। তার সঙ্গে যদি কমবয়সে বিয়ে এবং অনটন জুড়ে যায়? এমন প্রতিকূলতার পরেও অদম্য জেদ আর পরিশ্রমকে সঙ্গী করে সেই কাজই করে চলেছেন সিউড়ির ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের রুটিপাড়ার বাসিন্দা বাসিন্দা বছর তেত্রিশের রেখা খাতুন।
কষ্টের টাকায় জায়গা কিনেছেন। সরকারি সহায়তায় বাড়ি করেছেন। নিজে ব্যবসা করে সংসার চালান। ওঁর মেয়ে এ বার উচ্চ মাধ্যমিক দেবে। লক্ষ্য একটাই, যত কষ্টই হোক মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শুধু মেয়েকে মানুষ করা নয়, নিজের উদাহরণ তুলে ধরে এলাকার মেয়ে-বৌ’দের বাল্যবিবাহের কুফল নিয়ে সচেতন করার কাজও সমান ভাবে করে চলেছেন রেখা। তাঁর এই লড়াইকে কুর্ণিশ করছেন পাড়ার লোক।
খুব ছোটবেলায় বাবাকে হারানোয় পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণির বেশি এগোয়নি রেখাদেবীর। তার পরেই বিয়ে দেয় পরিবার। এমন এক জনের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল, সন্তান জন্মের আগেই যিনি স্ত্রী-র সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন। চরম দারিদ্রের মধ্যে সদ্যোজাত শিশুকন্যাকে বাঁচাতে যখন এ দরজা ও দরজা ঘুরছেন, তখনই তাঁর পাশে দাঁড়ায় সিউড়ির সরকার পোষিত হোম। ‘‘হোম সাহায্য করেছে ঠিকই। কিন্তু, ওর হার না মানা জেদ, পরিশ্রমে ভর করে দাঁড়ানোর চেষ্টা না থাকলে আজ এই পর্যন্ত পৌঁছতে পারত না’’—বলছেন, সমাজকর্মী ফরিদা ইয়াসমিন।
রেখাদেবী জানালেন, ১৪ বছরে যখন বিয়ে হয় তখন রাজনগরের বাসিন্দা। বিয়েও হয়েছিল রাজনগরেই। বিয়ের পর থেকেই স্বামীর তেমন রোজগার ছিল না। এর মাঝে আবার নেশা করতে শুরু করে। নিত্য অশান্তির সঙ্গে ছিল অত্যাচার। থানা, পুলিশও হয়। এক সময় স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক শেষ। তাঁর কথায়, ‘‘তখন আমি তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তখন দিদির পরিবারেও থাকা সম্ভব ছিল না। মেয়ে সামলে কাঁথাস্টিচের শাড়ি তৈরির কাজ শিখে দু’বেলা খেটেও পেট ভরার খাবার জুটত না। তখনই সিউড়ির হোমে ঠাঁই মেলে।’’
হোম সূত্রে জানা গিয়েছে, মেয়ের পড়াশোনাও হোম থেকেই শুরু। কিন্তু, হোমে থাকতে পেয়েছেন বলে পরিশ্রম থামাননি রেখা। নিজেই ঘুরে পাড়ায় পাড়ায় মনোহারি ও প্রসাধনী দ্রব্য ফেরি করা শুরু করেন। উদয়-অস্ত কাজ করে টাকা জমিয়ে সামান্য একচিলতে জায়গা কিনে পুরসভার নাগরিক হয়ে এক লাখি বাড়ি পান। ওই টাকায় টিনের ছাউনি করে ব্যবসা শুরু করেন। আয়ের ওই পথ ছাড়াও স্বনির্ভর দলে যোগ দেন। মেয়েকে সিউড়ির নামী মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করেন। এখন অর্থনৈতিক ভাবে কিছুটা স্বাচ্ছ্বল্য এসেছে। মেয়ে বড় হওয়ায় তাকে ছেড়ে আর কাঁথাস্টিচের কাজ করতে বাইরে যান না।
রেখা বলছেন, ‘‘মেয়ের যখন ছ’মাস তখনই শুনি আমার স্বামী আবার বিয়ে করেছে। খুব কষ্ট হয়েছে। কিন্তু, ঠিক করেছিলাম আমি মরব না। বাবা ছাড়াই মেয়েকে মানুষ করব। যা আয় করি আমার চলে যাচ্ছে।’’ সময় পেলেই পাড়ার মেয়ে, বৌদের কম বয়সে মেয়ের বিয়ে দিও না, এই প্রচার তো রয়েইছে। কাউন্সিলর প্রমীলা দে বলছেন, ‘‘শুধু মেয়েকে মানুষ করা নয়। ১৮ বছরের নীচে মেয়েদের বিয়ে হলে কী অসুবিধা, সেটা বোঝাতেও তো এলাকার মুখ রেখা।’’