কাজ: কুলো তৈরির ব্যস্ততা। বুধবার। নিজস্ব চিত্র
কেউ এনেছেন বেহালা। কারও হাতে বাঁশি, একতারা। কারওবা স্টলের চারপাশে বিছানো নিজেরই বানানো পাটের ব্যাগ, টুপি, পুতুল এমনকি পোস্টার।
মেলায় বিনোদন মঞ্চের পিছনে গেলে দেখা যাবে কাজের ব্যস্ততা। জিনিস বিক্রির মাঝেই তৈরিও করছেন। বাঁশের নানা জিনিস নিয়ে কেউ এসেছেন নদিয়া থেকে, কেউ মুর্শিদাবাদ থেকে। কিন্তু, খাটনি অনুযায়ী জিনিসের দাম পান না বলে মনে খারাপ তাঁদের। বললেন, ‘‘মানুষ আমাদের সঙ্গেই যত দরদাম করেন। এমন দাম বলেন যে, সেই দামে জিনিস দিতে পারি না।’’ নেপাল থেকে আনা কারিয়া বাঁশ দিয়ে ফুলদানি, মুখোশ, ল্যাম্পশেড, পেনদানি বানিয়ে দর্শনার্থীদের নজর কেড়েছেন দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে আসা সঞ্জিত বৈশ্য। তিনি অবশ্য বললেন, ‘‘গত ছয় বছর ধরে মেলায় আসছি। ভালই বিক্রি হয়।’’ ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত দামের জিনিস রয়েছে তাঁর কাছে।
শান্তিনিকেতনে প্রথম পৌষমেলা বসেছিল ১৮৯৪ সালের ৭ পৌষ। ছাতিমতলার ছায়ায় মন্দিরের পাশের মাঠে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ধর্ম্মভাব উদ্দীপনের জন্য’ মেলার প্রস্তাব করেছিলেন। ইতিহাস বলছে, প্রথম পৌষমেলায় খরচ হয়েছিল ১৭৩২ টাকা ১০ আনা। সেই খরচ কবেই লক্ষ টাকার গণ্ডি পেরিয়ে কোটি ছোঁয়ার মুখে। কিন্তু, যে প্রান্তিক জনের কথা ভেবে মেলার সূচনা হয়েছিল, তাঁদের ঠাঁই হয়েছে খুব অংশেই। যদিও মেলা কমিটি এই ব্যবসায়ীদের থেকে জায়গার কোনও ভাড়া নেন না। নিতান্তই অভ্যাসবশত কিংবা কিছু লাভের আশায় এখনও কিছু মানুষ গ্রামগঞ্জ থেকে আসেন এখনও।
মেলায় গিয়ে দেখা গেল, নিজেদের তৈরি বাদ্যযন্ত্র বিক্রি করছেন বেশ কিছু জন। প্রয়োজনে ক্রেতাদের হাতে ধরে শিখিয়েও দিচ্ছেন। গত ২৫ বছর ধরে কলকাতা থেকে বেহালা নিয়ে মেলায় আসেন গিয়াসুদ্দিন লস্কর। তিনি জানালেন, বেহালা বানান সারা বছর। এর পর পৌষমেলায় বিক্রি করতে চলে আসেন। ৫০ টাকা কিংবা ৬০ টাকা দামে বেহালা বিক্রি করছেন তিনি। বললেন, ‘‘আগে সাত জন মিলে একসঙ্গে আসতাম। এখন শুধু আমি একাই আসি।’’ পূর্ব বর্ধমান থেকে ২৪ বছর ধরে মেলায় বাঁশি বিক্রি করতে আসেন শঙ্কর মাল। বসেন ১৪০০ সাহিত্য স্টলের সামনে। শুধু বিক্রিই করেন না, তার সঙ্গে স্টলের অনুষ্ঠানে আবহশিল্পী হিসেবেও কাজ করেন। ৩০ টাকা থেকে শুরু করে তিন হাজার ৫০০ টাকা দামের বাঁশি মিলছে তাঁর কাছে। এঁদের মাঝে এ বারই প্রথম কৃষ্ণনগর থেকে একতারা বিক্রি করতে এসেছেন রাজু মাল। একতারার উপরে নানা কারুকাজ করে বিক্রি করছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বিক্রি মোটামুটি হচ্ছে। এখনও দু’দিন আছে। দেখা যাক কী হয়।’’
মুর্শিদাবাদ থেকে পাটের কাজ নিয়ে গত ১৫ বছর ধরে আসছেন হামজিলা বিবিরা। তিনি জানালেন, একই জায়গা থেকে এক সঙ্গে ২০-২৫ জন মিলে আসেন তাঁরা। পাটের ব্যাগ, টুপি, পুতুল, পোস্টার সবই নিজেরা বানান। জিনিসের মাপ অনুযায়ী দামের বিভিন্নতা রয়েছে। একই ভাবে পাটের জিনিস নিয়ে গত বছর থেকে মেলায় বসছেন প্রশান্ত বর্মন। তাঁর বানানো জিনিসগুলি আবার হামজিলা বিবিদের থেকে আলাদা। পাট দিয়েই তিনি বানিয়েছেন বুদ্ধমূর্তি, গণেশ, হনুমান, মুখোশ, পেঁচা, ঘোড়া, পেনদানি, ফুলদানি। ইলামবাজার থেকে এসেছেন সনাতন বাগদি। প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা বিভিন্ন জিনিস থেকে তিনি বানিয়েছেন ইঁদুর, পাখি, গণেশ। আমড়ার আঁটি থেকে শুরু করে হরিতকি সব কিছুই নতুন রূপ পেয়েছে। বাঁশের গয়নাও বানিয়েছেন তিনি। প্রায় ২৫ বছর ধরে এ ভাবেই মেলায় আসেন সনাতনবাবু। বিশ্বভারতীর প্রাক্তন ছাত্র বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রায় ২৫ বছর ধরে মেলায় পোড়ামাটির তৈরি জিনিস বিক্রি করেন। পোড়ামাটি দিয়ে বানানো ফুলদানি, মূর্তির পাশাপাশি এ বছর তিনি তৈরি করেছেন মাটির ফুল। ভাল বিক্রি হচ্ছে বলেও জানালেন তিনি।
এ ভাবেই নিজেদের অস্তিত্ব ধরে রাখতে এক দল মানুষ পৌষমেলায় নিজেদের হাতের কাজ বিক্রি করে আসছেন প্রতি বছর। এঁদের থেকে জায়গার ভাড়া হিসেবে কোনও টাকা নেয় না মেলা কমিটি। কিন্তু এঁরা যেন মেলা থেকে একেবারেই হারিয়ে না যান, সে দিকেও কর্তৃপক্ষকে নজর দিতে হবে বলেই মনে করছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে দর্শনার্থী সকলেই।