অমরকানন আশ্রম। ইনসেটে, গোবিন্দপ্রসাদ সিংহ। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।
প্রত্যন্ত বাঁকুড়ার জঙ্গলঘেরা একটি ব্লক গঙ্গাজলঘাটি। অথচ এই এলাকা থেকেই এক সময় গোটা জেলার স্বদেশি আন্দোলন পরিচালিত হত। এলাকার স্কুল, আশ্রম, আটচালা— সবেতেই যেন আজও রয়েছে সেই ইতিহাসের ছোঁয়া। মহাত্মা গাঁধী, নেতাজি থেকে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে নজরুল ইসলাম, সবাই ছুটে এসেছেন এখানে। আর এই সবের নেপথ্যে রয়েছেন এক জনই। তিনি গঙ্গাজলঘাটির ইতিহাসের কেন্দ্রবিন্দু গোবিন্দপ্রসাদ সিংহ। যাঁর আদর্শ, সাধনা ও লড়াই আজও অনুপ্রেরণা জোগায় দেশের কাজে মানুষকে এগিয়ে আসতে।
এই ব্লকেরই ছোট্ট একটি গ্রাম, যার তৎকালীন নাম কনেমারা। সেই গ্রামেই গোবিন্দপ্রসাদবাবুর জন্ম ১৮৮৯ সালে। পরবর্তীকালে গোবিন্দবাবুর নামেই এই গ্রামের নাম হয় গোবিন্দধাম। স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত, সারদা মায়ের কাছে দীক্ষিত গোবিন্দপ্রসাদবাবু এক দিকে যেমন আধ্যাত্মিক চরিত্র, অন্য দিকে তেমনই দেশপ্রেমী মুখ।
নৃপেন আকুলির ‘ঋষিকল্প গোবিন্দ প্রসাদ’ ও দীপক কুমার অগ্নিহোত্রীর ‘গোবিন্দদর্পণ’ বই থেকে জানা যায়, গাঁধীজির জাতীয় শিক্ষা পরিকল্পনায় যখন দেশে সরকারি সাহায্য বর্জন করে একের পর এক জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে উঠছে, তখন গোবিন্দবাবু গঙ্গাজলঘাটির এম ই স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে ছিলেন। তিনিও সিদ্ধান্ত নিলেন, এই স্কুলকে জাতীয় বিদ্যালয় করার। বিষয়টিকে কেন্দ্র করে প্রথমে খানিক বিতর্ক তৈরি হলেও শেষ পর্যন্ত গোবিন্দবাবুর অনড় অবস্থানে স্কুলটি জাতীয় বিদ্যালয়েই রূপান্তরিত হল। সমস্ত রকম সরকারি সাহায্য তুলে নেওয়া হল। তখন বিভিন্ন প্রান্তের সাধারণ মানুষ সাহায্যের হাত বাড়ালেন স্কুলের দিকে। বিদ্যালয়ে শুরু হল স্বামীজির গ্রন্থপাঠ, গীতা পাঠ। শিক্ষার পাশাপাশি ছাত্রদের শারীরিক ও মানসিক উন্নতির দিকটিও বিশেষ খেয়াল রাখতেন প্রধান শিক্ষক গোবিন্দবাবু। জাতীয় বিদ্যালয়ে গোবিন্দবাবুর সঙ্গে কাজ করতে এগিয়ে এলেন একদল যুবক। যাঁরা বিভিন্ন বিপ্লবী সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাঁদের অন্যতম অমরনাথ চট্টোপাধ্যায়। অমরনাথবাবু জাতীয় বিদ্যালয়ের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে তাঁর নিজের, গ্রাম বর্ধমানের দাঁইহাটের কালিকাপুরে যান। সেখানে গিয়ে কালাজ্বরে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
সেটা ১৯২৪ সাল। ওই বছরই তাঁর স্মৃতির উদ্দেশে গঙ্গাজলঘাটির মাছরাঙার ডাঙা এলাকার নাম ‘অমরকানন’ রাখেন গোবিন্দবাবু। গড়ে তোলেন অমরকানন আশ্রম। তার পরের বছর এই আশ্রমের শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ মন্দিরের দ্বারোদ্ঘাটন করেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। গাঁধীজির সফর সঙ্গী ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি এই আশ্রমে বসেই রচনা করেন ‘অমরকানন সঙ্গীত’। আজও এই সঙ্গীতই গোবিন্দপ্রসাদবাবুর জাতীয় বিদ্যালয় ‘অমরকানন দেশবন্ধু বিদ্যালয়’-এর প্রার্থনা সঙ্গীত হিসেবে গাওয়া হয়। অমরকানন আশ্রমকে কেন্দ্র করে স্বদেশি আন্দোলনের জোয়ার বইতে থাকে। যার জেরে এই আশ্রমটির উপর গোপন নজর রাখতে থাকে ব্রিটিশ পুলিশ। ১৯৩২ সালে গাঁধীজির ডাকে দেশ জুড়ে আইন অমান্য আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন গোবিন্দপ্রসাদবাবুর নেতৃত্বে বিরাট আকার নিয়েছিল বাঁকুড়া জেলা জুড়ে। গ্রেফতার হন গোবিন্দপ্রসাদবাবু-সহ বহু আন্দোলনকারী। বাজেয়াপ্ত করা হয় আশ্রমের যাবতীয় সম্পত্তি। প্রায় দেড় বছর পরে ফের এই আশ্রম বাজেয়াপ্ত মুক্ত করে কর্তৃপক্ষের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ১৯৪০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঁকুড়া যাওয়ার পথে এই আশ্রমের সামনে এলে গোবিন্দপ্রসাদবাবুর নেতৃত্ব কবিগুরুকে বরণ করা হয়।
অমরকানন দেশবন্ধু স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক ও গোবিন্দপ্রসাদের জীবনিকার দীপককুমার অগ্নিহোত্রী বলেন, ‘‘বাঁকুড়ায় গোবিন্দপ্রসাদবাবুর নেতৃত্বে ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল স্বদেশী আন্দোলন। তবে ইতিহাসের পাতাতে তার ঠাঁই হয়নি। কোথাও লেখা হয়নি গোবিন্দপ্রসাদবাবুর নামও। অথচ এই মানুষটার জীবনকে জনগণের সামনে তুলে ধরা বর্তমান পরিস্থিতিতে খুব জরুরি।’’
১৯৪০ সালের ২৮ এপ্রিল সুভাষচন্দ্র বসু গঙ্গাজলঘাটিতে ফরওয়ার্ড ব্লকের একটি সভা করতে আসেন। নেতাজি কংগ্রেসে থাকাকালীন গোবিন্দবাবুর সঙ্গে তাঁর পরিচয়। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে আলাদা ভাবে দেখা করে তাঁকে আমরকানন দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে নামার পরামর্শ দিলেন গোবিন্দবাবু। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানানোর দায়িত্ব দিলেন এই স্কুলের তৎকালীন সম্পাদক ধীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। ধীরেন্দ্রনাথবাবু নেতাজির আদর্শেই কংগ্রেস ছেড়ে তত দিনে ফরওয়ার্ড ব্লকে যোগ দিয়েছেন। নেতাজি দেশবন্ধু বিদ্যালয়ে আসার পরে তাঁকে সাড়ম্বরে স্বাগত জানানো হল। কিন্তু, গোবিন্দপ্রসাদবাবু সেখানে উপস্থিত থাকলেন না। কারণ, তিনি তখনও কংগ্রেসে।
১৯৪১ সালের ৩০ জানুয়ারি বাঁকুড়ায় আসেন ভারতীয় জনসঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা তথা ‘অখিল ভারতীয় হিন্দু মহাসভা’-র সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। শ্যামাপ্রসাদবাবু তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সেনেটের সদস্যও। জেলায় আসা শ্যামাপ্রসাদবাবুকে ১ ফেব্রুয়ারি অমরকানন দেশবন্ধু বিদ্যালয়ের আসার অনুরোধ জানালেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। শ্যামাপ্রসাদবাবুর কাছে দেশবন্ধু বিদ্যালয়কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনের প্রস্তাব দেওয়াই ছিল মূল লক্ষ্য। গোবিন্দপ্রসাদবাবু এতে সম্মতিও দিয়েছিলেন। কিন্তু, নিজের দলের আদর্শের কথা মাথায় রেখে ব্যক্তিগত ভাবে গোবিন্দপ্রসাদবাবু শ্যামাপ্রসাদবাবুর সঙ্গে আলোচনায় বসতে রাজি হলেন না। ও দিকে, এই আলোচনায় তিনি না বসলে আখেরে স্কুলের ক্ষতিই হবে। স্কুল কর্তৃপক্ষের জোরাজুরিতে এক প্রকার বাধ্য হয়েই রাজি হলেন গোবিন্দপ্রসাদবাবু। বৈঠকে শ্যামাপ্রসাদবাবুর আশ্বাস মিলল। শেষ অবধি সেনেটের বৈঠকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন লাভ করল অমরকানন দেশবন্ধু বিদ্যালয়। ১৯৪৭ সালের ১৩ এপ্রিল ওই স্কুলের নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে শ্যামাপ্রসাদবাবু ফের অমরকাননে আসেন। তখন গোবিন্দপ্রসাদবাবু অসুস্থ। তাঁকে দেখতে যান শ্যামাপ্রসাদবাবু। রাজনৈতিক ভাবে দু’জনের আদর্শগত ফরাক থাকলেও ব্যক্তিগত সম্পর্কে তার প্রভাব কখনও পড়েনি।
গোবিন্দপ্রসাদবাবুর নেতৃত্ব এই জেলায় কংগ্রেসের জোরালো সংগঠন গড়ে উঠেছিল। তবে, স্বাধীনতা লাভের পরে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে যান। ১৯৫৪ সালের ১৭ই ডিসেম্বরে তাঁর মৃত্যু হয় নিজের হাতে গড়া আশ্রমেই। সেই সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় বাঁকুড়ার এক সোনালি অধ্যায়।