গুপ্তঘাতকের অস্ত্রে খুন হন সত্যকিঙ্কর

ঝালদার বাতাসে ওড়ে ইতিহাস। রাজকাহিনি থেকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই— অনেক ঘটনার কেন্দ্রে পুরুলিয়ার পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট জনপদ ঝালদা। সে সব কথা এখনও কিছু প্রবীণের মুখে শোনা যায়। তবে হারিয়ে যাচ্ছে আরও অনেক কাহিনি। কিংবদন্তি বলছে, এক সময় এই ঝালদা শহরেই গড়ে উঠেছিল পঞ্চকোট রাজবংশের প্রথম রাজধানী। গবেষকদের মতে, সে খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিককার কথা।

Advertisement

প্রশান্ত পাল

ঝালদা শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০১৫ ০০:০৫
Share:

শহিদ সত্যকিঙ্কর দত্তের মূর্তি। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।

ঝালদার বাতাসে ওড়ে ইতিহাস।
রাজকাহিনি থেকে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই— অনেক ঘটনার কেন্দ্রে পুরুলিয়ার পাহাড়-জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট জনপদ ঝালদা। সে সব কথা এখনও কিছু প্রবীণের মুখে শোনা যায়। তবে হারিয়ে যাচ্ছে আরও অনেক কাহিনি।

Advertisement

কিংবদন্তি বলছে, এক সময় এই ঝালদা শহরেই গড়ে উঠেছিল পঞ্চকোট রাজবংশের প্রথম রাজধানী। গবেষকদের মতে, সে খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিককার কথা। জেলার জনপদের ইতিহাস গবেষক দিলীপকুমার গোস্বামীর কথায়, মধ্যপ্রদেশের ধারা নগরের রাজা ও রানি জগন্নাথধাম দর্শনে পুরী যাচ্ছিলেন। যাওয়ার পথে বর্তমান ঝালদার অদূরে পাট ঝালদার জঙ্গলে রানি একটি সন্তানের জন্ম দেন। রাজপুরোহিত আগেই ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন, ওই সন্তান নতুন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু সদ্যোজাত ওই শিশু মৃত হওয়ায় জঙ্গলে ফেলেই রাজা-রানি পুরী রওনা দেন। সেখান থেকে ফেরার পথে তাঁরা খবর পান, এলাকার সর্দার পরিবার জঙ্গলে একটি শিশুকে পেয়ে পালন করছেন। শিশুটি রাজারই সন্তান ভেবে সেখানেই থেকে যান রাজপুরোহিত। রাজা-রানি অবশ্য ধারানগরে ফিরে যান। সর্দার পরিবার নিঃসন্তান হওয়ায় ওই শিশুকেও তাঁরা ছাড়তে রাজি হননি। রাজপুরোহিত বনমালি পণ্ডিতের কাছেই সেই শিশু শাস্ত্র ও অস্ত্র শিক্ষা গ্রহণ করে। কালে কালে সেই ‘সর্দার-পুত্রই’ রাজপুরোহিতের সাহায্যে একটি নতুন রাজ্য স্থাপন করেন। সেই রাজ্যই হল ‘পঞ্চকোট’ আর পঞ্চকোটের রাজধানী হল ঝালদা। দিলীপবাবু জানান, যদিও এই রাজবংশ পরবর্তী কালে তাদের রাজধানী বিভিন্ন জায়গায় বদলে শেষে ১৮৩২ সালে কাশীপুরে এসে থিতু হয়। তাঁদের পরবর্তী সময়ে ঝালদায় আরও এক রাজবংশ ছিল। তাঁদের নিয়েও কাহিনি রয়েছে।

ঝালদার ইতিহাসের সঙ্গে আরও একটি পর্ব জুড়ে রয়েছে— সত্যকিঙ্কর দত্ত। ঝালদা পুরসভার অদূরে পুরুলিয়া-রাঁচি রাস্তার ধারে কিছু অস্থায়ী দোকানে কাছে রয়েছে তাঁর আবক্ষ মূর্তি। অবহেলায় এক কোণে রয়ে গিয়েছে। সেই মূর্তির নীচে লেখা ‘গেলি ফিরে সত্য, সত্যের কাছে জানাতে অবিচার, দেশের অবিচার সত্যকিঙ্কর দত্ত’। ঝালদার মানুষজনের কাছে সবর্জনশ্রদ্ধেয় এই ব্যক্তি। কিন্তু নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছেই তিনি এখন ‘অচেনা’।

Advertisement

ইতিহাস বলে ঝালদার রাজা হরিহরের সময়ে ঝালদায় সিপাহি বিদ্রোহ হয়। বিদ্রোহে যোগ দেওয়ায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজাকে হাজারিবাগের জেলে নিয়ে গিয়ে বন্দি করে। তবে মুক্তি পেয়ে রাজা হরিহর কোম্পানির পক্ষ অবলম্বন করেন। দিলীপবাবুর কথায়, ‘‘সেই থেকে ঝালদা রাজপরিবার দেশের স্বাধীনতা পর্যন্ত ইংরেজ সরকারের পক্ষেই থাকে। ঝালদার বাসিন্দাদের মধ্যে পুরসভার প্রথম চেয়ারম্যান হন রাজা উদ্ধবচন্দ্র সিংহ। ১৯২২-১৯৩৮ সাল এবং পরে ১৯৪১-১৯৫১ সাল পর্যন্ত ঝালদা পুরবোর্ডের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। এই সময় কালেই জেলায় স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রথম শহিদ হন সত্যকিঙ্কর দত্ত।

১৯২২ সালের ২৭ ও ২৮ এপ্রিল ঝালদায় মানভূমের দ্বিতীয় রাজনৈতিক সম্মেলন হয়। দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ-সহ অনেক বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই সম্মেলনে হাজির ছিলেন। ঝালদা শহরের বাসিন্দা সেবাদাস ডোম, শিবশরণ লাল জয়সওয়াল, প্রেমচাঁদ মোদক প্রমুখ কংগ্রেস মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিবর্গ সম্মেলন আয়োজনের দায়িত্বে ছিলেন। যুবকর্মী সত্যকিঙ্কর দত্ত সম্মেলনের স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন। ইংরেজ সরকারের পক্ষে থাকা রাজা কৃষক আন্দোলন গড়ে উঠতে দেখে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। সম্মেলনের পরে ঝালদায় স্বদেশি আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে। এলাকার যুবকদের লাঠিখেলা শেখাতেন সত্যকিঙ্কর। ১৯২৯ সালের ১০ ডিসেম্বর গুপ্তঘাতকের বিষ মাখানো ধারালো অস্ত্রের আঘাতে সত্যকিঙ্কর আহত হন। ১৩ ডিসেম্বর পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে সত্যকিঙ্কর দত্তের মৃত্যু হল। এই মৃত্যুর ঘটনা শুধু ঝালদাকেই নয়, নাড়া দেয় গোটা মানভূমকেই। ঘটনায় নাম জড়াল রাজপরিবারের। পুলিশ এই হত্যায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে।

শোনা যায়, সত্যকিঙ্করের মৃত্যুর একমাস দু’দিন পরে ১৯৩০ সালের ১৫ জানুয়ারি (পয়লা মাঘ) সত্যঘাট মেলার আয়োজন করে ঝালদা যুবসঙ্ঘ। দিলীপবাবু জানান, কয়েক হাজার মানুষের উপস্থিতিতে উপেন্দ্রমোহন দাশগুপ্তর নেতৃত্বে হওয়া সভায় মহিলারাও ছিলেন। সত্যকিঙ্করের চিতাশয্যার উপরে তাঁর স্মৃতি মন্দির স্থাপন করেন জীমূতবাহন সেন। গঠিত হল সত্যকিঙ্কর স্মৃতিরক্ষা কমিটি। সিদ্ধান্ত হল, প্রতি সোমবার সত্যটাঁড় মেলায় হাট বসানোর। ওই হাটে কোনও কর নেওয়া হবে না। অচিরেই হাট জনপ্রিয় হয়ে উঠল এলাকায়। সোমবারের এই হাটটি ঝালদার মঙ্গলবারের সাপ্তাহিক হাটের বিকল্প হয়ে উঠতে থাকায় রাজার সম্মানে লাগে। তিনি শিবশরণ লাল জয়সওয়াল, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, মোহনদাস বাবাজি-সহ আট জনের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন। ১৯৩০ সালে কাঁসরা গ্রামে পুলিশ প্রথম চার জনকে গ্রেফতার করে।

পরের বছর পয়লা মাঘ পুলিশ সত্য মেলার আয়োজনে ১৪৪ ধারা জারি করে। তা উপেক্ষা করে দলে দলে মানুষ এলেন। দিলীপবাবু বলেন, ‘‘পুলিশ বাজনা থামাতে বলায় নতুনডি গ্রামের গোলক মাহাতো পুলিশকে চড় মারেন। পুলিশ গুলি চালায়। গুলিতে শহিদ হলেন পাঁচ জন।’’ এই হত্যালীলা শুধু মানভূমেই নয়, বিহার ও ওড়িশার রাজনীতিতেও আলোচিত হয়।

কিন্তু, মানভূমের স্বাধীনতা আন্দোলনের এই প্রথম শহিদ কি পেয়েছেন তাঁর যোগ্য সম্মান? প্রশ্ন ঘোরে ঝালদায়। সত্যকিঙ্করের আবক্ষ মূর্তি আজ ঢাকা পড়েছে রকমারি দোকানের পসরার আড়ালে। ওই শহিদ-পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম শ্যামলী দত্তের আক্ষেপ, ‘‘তাঁর মূল্যায়ন ঠিকমতো হয়নি।’’ শ্যামলীদেবী এখন তৃণমূলে। তাঁর দলও তো সত্যকিঙ্করকে যোগ্য মর্যাদা দেয়নি? শ্যামলীদেবী বলেন, ‘‘দেখি, জেলার মন্ত্রীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলব।’’

স্থানীয় বাসিন্দা তথা বাঘমুণ্ডির বিধায়ক নেপাল মাহাতো বলেন, ‘‘যে ভাবে এই শহিদের মূল্যায়ন হওয়া উচিত ছিল, তা হয়নি। শহিদের মর্যাদা পাননি সত্যকিঙ্কর দত্ত। চলতি বছর ঝালদা সত্যভামা বিদ্যালয়ের শতবর্ষ। আমরা সেই উপলক্ষে এই শহিদদের স্মরণে একটি গ্যালারি ও একটি স্মারক তৈরির কথা ভেবেছি, যাতে আগামী প্রজন্ম এঁদের কথা জানতে পারে।’’

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement