জল খেলা। গত বারের তুলনায় এ বার বিশ্বভারতীর নতুন সুইমিংপুলে ভিড় বেড়েছে। কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য নয়, সেখানে ভর্তি হয়েছেন বোলপুর-শান্তিনিকেতন এলাকার বহু মানুষ। চলছে প্রশিক্ষণ। বুধবার ছবিটি তুলেছেন বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
সদ্য সদ্য জেলার ভোটগ্রহণ পর্ব শেষ হয়েছে। কিন্তু ভোট পরবর্তী হিংসায় রাজনৈতিক দলের পারদ যতো চড়ছে, তার চেয়ে ঢের ঊর্ধ্বগামী শ্রীনিকেতন হাওয়া অফিসের পারদ!
এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে বোলপুর-শান্তিনিকেতনে এ আর নতুন কী! কিন্তু, দিন দিন এই শহরের গরম যেন দুঃসহ হয়ে উঠছে। গত বুধবার থেকেই তাপপ্রবাহ শুরু হয়েছিল বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বর্ধমান, বীরভূমে। গত বৃহস্পতিবার তা আরও তীব্র আকার নিয়েছে। তার জের চলতি সপ্তাহেও। সকাল ৯টাতেই রাস্তা সুনসান। ঘরের ভিতর ওষ্ঠাগত প্রাণ বাসিন্দাদের। দিনের বেশির ভাগ সময় বাড়িতেই বন্দি থাকছেন তাঁরা। কেউ কেউ আবার সুইমিং পুলে ভর্তি হচ্ছেন। ভোর ভোর অথবা সূর্যের তাপ কমতেই ছুটছেন সুইমিং পুলে। সন্ধেয় ভিড় এলাকার আইসক্রিম পার্লার, ঠাণ্ডা পানীয়ের দোকানে। ভিড় চোখ পড়ছে ফ্যান, এসি এবং ফ্রিজের দোকানে। গরমের জ্বালা এতই প্রবল যে, সে নিয়ে জোর চর্চা চলছে ফেসবুক-হোয়াটস অ্যাপেও!
শ্রীনিকেতনের আবহাওয়া দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, গত চার দিনের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা কখন চুয়াল্লিশের আশেপাশে ঘুরছে আবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৬ আশেপাশে থাকছে। তবে তাপমাত্রা হু হু করে বাড়লেও, মন্দের ভাল হাওয়া দেওয়ায়। কিছুটা স্বস্তি এই লু-তেও। কেমন ছিল এই চার দিনের তাপমাত্রা? হাওয়া অফিস সূত্রে খবর, রবিবার সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৪৩-৫ এবং ২৬-৯ ডিগ্রি। পরের দু’ দিন যথাক্রমে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল যথাক্রমে ৩৭-২ ও ২৬-৭ এবং ৩৫-৪ ও ২৫-৯ ডিগ্রি।
ভিড় সুইমিংপুলে
‘‘বাড়ি চলে যাব। জাস্ট বের হতে পারছি না। মুখ-চোখ জ্বালা করছে। তবু দরকারে তো বের হতেই হচ্ছে, মুখে ওড়না জড়িয়ে বাইরে যাচ্ছি। প্রতিবার এই সময়টা যে কি কষ্ট হয়!’’ বলছিলেন বিশ্বভারতীর কলাভবনের এক ছাত্রী। প্রবল গরমে এমন অভিজ্ঞতা বেশিরভাগেরই। যাঁরা শান্তিনিকেতনে রয়েছেন, অনেকেই বিশ্বভারতীর সুইমিংপুলে ভর্তি হচ্ছেন। ওই পুলের পাবলিক রিলেশন কো-অডিনেটর ভ্রমর ভাণ্ডারী বলেন, ‘‘দিন দিন ভিড় বাড়ছে, সে নিয়ে কোনও তর্কই নেই। গতবারের তুলনায় এ বারে প্রায় ১০০ জন বেড়েছে। দাবদাহের কারণে সুইমিং পুলের চাহিদা বাড়তে থাকায়, বিশ্বভারতীর পরিবার ছাড়াও সুইমিং পুল ব্যবহারে শর্তাধীন এলাকার একাধিক স্কুল, কলেজের পড়ুয়া এবং বহিরাগত, পর্যটকদের জন্য রয়েছে ওই সুবিধা সুযোগ।’’
বিশ্বভারতীর বোটানি তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী নাফিসা সুলতানা, পাঠভবনের দশম শ্রেণির ছাত্রী বিদিশা চট্টোপাধ্যায়, প্রাচীন ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষের ছাত্রী উপাসনা ছেত্রীর কথায়, প্রবল গরম পড়েছে। পুলে সাঁতার কেটে শরীর চর্চা যেমন হচ্ছে, ঠাণ্ডা জলে কিছুক্ষণ প্রাণ জুড়োচ্ছে। তাতে অনেকটাই গরমে মুক্তি মিলছে। প্রসঙ্গত, এই পুলটিতে একসঙ্গে ৭৫ জন সাঁতার কাটতে পারেন। এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতার আয়োজনের ব্যবস্থা রয়েছে পুলে।
ঠাণ্ডার খোঁজে
বিকেল নামতেই বোলপুর-শান্তিনিকেতনে এখন চেনা ভিড় আইসক্রিম পার্লারের সামনে। বোলপুর শান্তিনিকেতন এলাকার একটি ঠাণ্ডা পানীয় এবং আইসক্রিম দোকানের মালিক বিভাস হোম রায় বলেন, ‘‘এ বার ঠাণ্ডা পানীয় এবং আইসক্রিমের বিক্রি বেড়েছে। তবে তাপমাত্রা যে হারে বাড়ছে তাতে ইদানিং মানুষজন খুব কমই বাইরে বেরোচ্ছেন। ফলে দিনের বেলা ১০টার মধ্যে এবং বিকেলে পাঁচটার পরেই যা ব্যবসা হচ্ছে।’’ একই ভাবে এলাকার একটি ইলেকট্রনিক্স দোকানের মালিক সন্দীপ ভকত জানালেন, ‘‘এই মরসুমে বহু এসি, ফ্যান এবং ফ্রিজের বিক্রি বেড়েছে। সিলিং ফ্যান থেকে কদর বেশি টেবিল ফ্যানের।’’
ঠাণ্ডার খোঁজে সুতির পোশাকের বিক্রিও বেড়েছে। চৈত্রের শেষে এবং বৈশাখে অন্যান্য বারের তুলনায় সাদা জামাপ্যান্ট এবং সুতির কাপড়ের বিক্রি এ বার অনেকটাই বেড়েছে বলে জানাচ্ছেন এলাকার একটি বস্ত্র বিপণির মালিক মুলচাঁদ আগরওয়াল, সুশীল আগরওয়াল প্রমুখেরা।
গরম হাওয়া থেকে বাঁচতে মুখ ঢেকেছেন স্বাস্থ্যকর্মী। ময়ূরেশ্বরে তোলা নিজস্ব চিত্র।
কেন গরম বাড়ছে?
যে ভাবে লু বইছে তাতে অবাক হচ্ছেন অনেকেই। এ বার এমন পরিস্থিতি কেন? আলিপুরের আবহাওয়া অফিসের বিজ্ঞানীরা বলছেন, ঝাড়খণ্ড এবং লাগোয়া মধ্য ভারত থেকে শুকনো গরম হাওয়া ছুটে আসছে। তার জেরেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে পশ্চিমাঞ্চলে। এই সময় বঙ্গোপসাগরে থাকা উচ্চচাপ বলয় থেকে টানা জোলো হাওয়া জোগান থাকে গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে। শুকনো গরম হাওয়ার ঠেলায় উচ্চচাপ দূরে সরে গিয়েছে।
বিশ্বভারতীর পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের অধ্যাপিকা শিবানী চৌধুরী বলেন, ‘‘যে ভাবে কার্বন ডাই-অক্সাইডের স্তর বেড়েছে, এই এলাকাতেও বেড়েছে। বোলপুর-শান্তিনিকেতন এলাকায় প্রচুর বাড়ি-গাড়ি বেড়েছে কয়েক বছরে। কংক্রিটের রাস্তা বেড়েছে। ফলে স্বাভাবিক কারণেই গাছের সংখ্যাও কমছে। আর এ সবের ফলে পুকুর শুকিয়ে যাচ্ছে। জলস্তর নীচে নামছে। বাতাসে আদ্রতা কমেছে। ভৌগিলিক দিক থেকে বলতে গেলে, এলাকাটা লালমাটি। আয়রনও বেশি। সেক্ষেত্রে গরমের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে এখানে বেশি।
কী বলছেন চিকিৎসকেরা?
চিকিৎসক মোহিত সাহা বলেন, ‘‘যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে তাতে বলব, ঘরের ভিতরে থাকুন জরুরী প্রয়োজন ছাড়া। বাইরে যেতে হহলে, ছাতা, রোদচশমা, টুপি ব্যবহার করুন। পাশাপাসি স্কিন বার্ন আটকাতে ইউভি রে থেকে বাঁচতে, মেডিকেটেড এসপি এফ ১৫ বা তার বেশি এসপিএফের সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে পারেন। এই গরমের কারণে, শরীরে শুষ্কতা বাড়ে। বেশি করে জল খান। নুন চিনির সরবৎ, ডাবের জল খান। তরমুজ-বেলের সরবৎ খান। বাইরের জল, রঙিন সরবত, মশলাদার খাবার এড়িয়ে চলুন। শরীর ঠাণ্ডা রাখুন। রোদ থেকে ঘরে ঢুকেই এসি চালাবেন না। টানা রোদে থাকলে ঠান্ডা পানীয় এড়ানো ভাল।’’