বৈধ না অবৈধ, এই বিতর্কের জাঁতাকলে আটকে থাকা বীরভূমের পাথর শিল্পাঞ্চলের অচলাবস্থা কাটাতে উদ্যোগী হয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওই জট কাটাতে মন্ত্রিগোষ্ঠী বা জিওএম (গ্রুপ অফ মিনিস্টার্স) গঠিত হয়েছে। পাশাপাশি তৈরি করা হয়েছে সচিব পর্যায়ের কমিটিও। বৃহস্পতিবার জয়দেবের মঞ্চ থেকে পাথর শিল্পাঞ্চলের সঙ্গে জড়িত সকলের উদ্দেশে এই বার্তা দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর আশা, এর ফলে সমাধানসূত্র মিলবে। সঙ্গে মাওবাদী নিয়ে খোঁচা দিতেও তিনি ছাড়েননি।
জেলায় ‘বন্ধ’ পাথর শিল্পাঞ্চলে অচলাবস্থা কাটাতে ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল পাথর শিল্পাঞ্চল বাঁচাও কমিটি। ২৯ ডিসেম্বর জেলাশাসককে স্মারকলিপি দিতে এসে কমিটির নেতারা জানিয়েছিলেন, তাঁরা আগে প্রশাসনকে জানালেন। মুখ্যমন্ত্রী জেলায় এলে তাঁকেও সমস্যার কথা জানাবেন। ১০ তারিখের অচলাবস্থা না কাটলে জেলা জুড়ে পাথর শিল্পের ঝাঁপ বন্ধ করে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেয় কমিটি। তবে, মুখ্যমন্ত্রী নিজে উদ্যোগী হওয়ায় আন্দোলন চূড়ান্ত আকার নেবে না বলেই আশা জেলা প্রশাসনের কর্তাদের।
ঘটনা হল, জাতীয় পরিবেশ আদালতের ছাড়পত্র এবং ‘ই-অকশন’-এর ভিত্তিতে ছাড়পত্র না মেলায় বীরভূমের রাজগ্রাম, নলহাটি, রামপুরহাট, শালবাদরা এবং মহম্মদবাজারের পাঁচামি ও তালবাঁধ এলাকা মিলিয়ে গোটা পাথর শিল্পাঞ্চলের অধিকাংশ খাদানই কাগজেকলমে বন্ধ হয়ে রয়েছে। ২১৭টি পাথর খাদানের মধ্যে খাতায়-কলমে মাত্র ৬টি পাথর উত্তোলনের ছাড়পত্র পেয়েছে। বাকিগুলি সরকারি ভাবে বন্ধ। একই কারণে বন্ধ থাকার কথা জেলার ১ হাজার ১৬৭টি পাথর ভাঙার কল (ক্রাশার)।
গত বছর জানুয়ারিতে পরিবেশ আদালত নির্দেশ দেয়— বালি, পাথর, মোরাম তুলতে গেলে পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র লাগবে। গত বছরই ২৯ জুলাই রাজ্য প্রশাসন নির্দেশ দেয়, সরকারি শর্ত পূরণ করে মোটা টাকার বিনিময়ে ‘ই-অকশন’ প্রক্রিয়ায় সামিল হতে হবে। তার ভিত্তিতেই মিলবে পাথর খাদানের লিজ। সে সব শর্ত পূরণ না হওয়ায় নোটিস জারি করে বেশির ভাগ পাথর খাদান বন্ধের নির্দেশ দেয় বীরভূম জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন সূত্রে অবশ্য জানা যাচ্ছে, সরকারি নিষেধাজ্ঞা না মেনে কমবেশি কাজ চলছে ‘বন্ধ’ প্রায় সব খাদানেই।
পাথর খাদান-ক্রাশার মালিকপক্ষের যুক্তি, জেলার অর্থনৈতিক মেরুদণ্ডই হল পাথর শিল্পাঞ্চল। তাঁরা চান না, অবৈধ তকমা নিয়ে এই শিল্প চলুক। কমিটির নেতাদের কথায়, ‘‘পাথর শিল্পাঞ্চল থাকা ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান সরকার সমধান বের করেছে। সেই পথে কেন হাঁটছে না সরকার? আমাদের দাবি, বৈধ-অবৈধ এই বিতর্ক মিটিয়ে একটা সুষ্ঠু সমাধানসূত্র বের করুক সরকার।’’ তা না হলে দিন দশেক পাথর শিল্পাঞ্চল বন্ধ থাকলে, রাজ্য জুড়ে সমস্ত নির্মাণ কাজ যখন থমকে যাবে, প্রশাসনের টনক নড়বে তখনই—এমন হুঁশিয়ারি একান্তে দিচ্ছেন পাথর শিল্প কমিটির একাধিক কর্মকর্তা।
প্রশাসনের কর্তাদের বক্তব্য, শিল্পাঞ্চল নিয়ে জটিলতার প্রধান কারণ, পাথর খাদানগুলির প্রায় ৯০ শতাংশই ব্যক্তিগত মালিকানাধীন জমিতে থাকায়। খনিজ সম্পদে সরকারের অধিকার থাকলেও, ব্যক্তিগত জমি খাদানের জন্য নিলামে তোলার ক্ষেত্রে আইনগত বাধা রয়েছে। দ্বিতীয়ত, পাথর শিল্পাঞ্চল জোর করে বন্ধ করতে গেলে এর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জড়িত কয়েক লক্ষ মানুষ রুজি হারাবেন। তাতে আইনশৃঙ্খলা জনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রশাসন তা-ই এ নিয়ে এখনই কড়া পদক্ষেপ করতে চায়নি।
কিন্তু, কাগজেকলমে খাদান ও ক্রাশারগুলি বন্ধ থাকায় সরাসরি সেখান থেকে রাজস্ব আদায় করতে পারছে না প্রশাসন। অভিযোগ, ঘুরপথে পাথর পরিবহণের সঙ্গে যুক্ত যানবাহনের কাছ থেকে জরিমানা নিয়ে এখনও পর্যন্ত প্রশাসন ৪৫ কোটি টাকারও বেশি আদায় করেছে। এই জরিমানা নিয়েও ক্ষোভ রয়েছে পাথর শিল্পের মালিকপক্ষের অন্দরে। বুধবার আমোদপুরের সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে একটিও কথা না বলায় হতাশ ছিলেন তাঁরা। বৃহস্পতিবার জয়দেবে বাউল ও লোক উৎসবের উদ্বোধনে এসে এই সমস্যা নিয়ে তিনি আশার কথা শোনালেন। মমতা বলেন, ‘‘পরিবেশ আদালতের রায় ও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশই সমস্যা রয়েছে। এখানে সরকারের কোনও ভূমিকা নেই। তবুও অচলাবস্থা কাটাতে সরকার চেষ্টা করছে।’’ তাঁর আরও অভিযোগ, ঝড়খণ্ডের কিছু মাওবাদী নেতা এখানে এসে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা চলাচ্ছে।
কমিটি নেতাদের পাল্টা দাবি, এখানে মাওবাদী বলে কিছু নেই। মানুষ অসবিধায় পড়েছে বলেই আন্দোলনের পথে হাঁটতে হচ্ছে। তাঁদের আরও বক্তব্য, ঝাড়খণ্ডেও ব্যাক্তিগত মালিকানাধীন জমি রয়েছে। সেখানেও ১৭০টি খাদান অনুমতি পেয়েছে। এখানেও সরকারের সদিচ্ছা থাকলেই কাজ হবে। জেলা শিল্পাঞ্চল কমিটির সভাপতি নাজির হোসেন মল্লিক এবং সম্পাদক কমল খান বলেছেন, ‘‘পাথর শিল্পাঞ্চল অচল করা নিয়ে ৭ তারিখ আমাদের বৈঠক রয়েছে। সেখানেই মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি নিয়ে আলোচনা হবে। আন্দোলন থেকে সরে আসছি না। যেহেতু মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের সর্বময় কর্ত্রী, সংঘাতের পথে না গিয়ে তাঁর আশ্বাস মাথায় রাখা।’’