বিতর্কের আর এক নামই যেন অনুব্রত!
মঙ্গলবার মহম্মদবাজারের হিংলো পঞ্চায়েতের সারেন্ডায় তৃণমূলের মহিলা কর্মিসভায় আবারও বেসুরো গেয়ে বসলেন জেলা তৃণমূলের সভাপতি। প্রকাশ্য সভায় হুঁশিয়ারি দিলেন, ‘‘১৭ তারিখের পরে (ওই দিনেই ভোট রয়েছে বীরভূমে) আমরা গাঁওতার বিষ দাঁত ভেঙে দেব।’’
মুহূর্তে দানা বেঁধেছে বিতর্ক। যাঁর বিরুদ্ধে আক্রমণ শানিয়েছেন অনুব্রত, সেই আদিবাসী সংগঠনের সম্পাদক রবিন সোরেন কমিশনে অভিযোগ জানাতে চলেছেন। সমালোচনায় সরব হয়েছে বিজেপি থেকে বাম-কংগ্রেস নেতারাও। এঁদের সকলেরই প্রশ্ন, ‘‘আর কত অভিযোগ কমিশনে জমা হলে অনুব্রতর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন কমিশনের কর্তারা?’’
স্থানীয় সূত্রে খবর, মঙ্গলবার দুপুরে সারেন্ডায় মহিলা তৃণমূলের কর্মিসভা ছিল। আগুনে রোদকে উপেক্ষা করে প্রায় হাজার দেড়েক মহিলা সমর্থক সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মিনিট দশেক বক্তব্য রাখেন জেলা তৃণমূলের সভাপতি। কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, সবুজ সাথী-সহ রাজ্য সরকারের উন্নয়নমূলক নানা কাজের ফিরিস্তি তুলে ধরেন। এরপরেই হুঙ্কার ছাড়েন, ‘‘আমরা জানি, কোন কোন দল ভয় দেখায়। গাঁওতা নাকি মাঝে মাঝে ভয় দেখায়! তাই ১৭ তারিখের পরে আমরা গাঁওতার বিষ দাঁতটা ভেঙে দেব। জোর গলায় বলে গেলাম।’’
এক সময়ের শরিক দল গাঁওতাদের প্রতি হঠাৎ হুঙ্কার কেন?
এর পিছনে ভোট রাজনীতির সমীকরণকেই দেখছেন রাজনীতির কারবারিরা। এই মহলের মত, রামপুরহাট কেন্দ্রের বিস্তীর্ণ এলাকায় গাঁওতার প্রভাব আছে। বিশেষ করে, মহম্মদবাজারের পাথর শিল্পাঞ্চল এলাকায় গাঁওতার প্রভাবের কথা অনেকেই মানেন। সেই কেন্দ্রেই এ বার বিধানসভার প্রার্থী হয়েছেন সংগঠনের জেলা সম্পাদক রবিন সোরেন। সংগঠনের তরফে দাবি, গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে ২০০৯ সাল থেকেই এলাকার উন্নয়ন ও দূষণ রোধের দাবিতে তাঁরা সরব। সেই নিয়েই সে সময়ের বাম সরকারের সঙ্গে গাঁওতার বিরোধের শুরু। গত বিধানসভা নির্বাচনে গাঁওতা পূর্ণ সমর্থন করে তৃণমূলকে। কিন্তু তৃণমূল এলাকা উন্নয়ন বা দূষণ রোধের ব্যাপারে যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা পূরন করেনি বলে অভিযোগ নেতৃত্বের।
সেই ক্ষোভ থেকেই এ বার আদিবাসী এই সংগঠনের তরফে বীরভূমের ১১টি আসনের মধ্যে ১০টি আসনে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। অনেকের মতে, সংগঠনের শক্ত ভিত রয়েছে রামপুরহাটে। সেই বাধ্যবাধকতা থেকেই অনুব্রতর সরব হওয়া বলে মনে করছেন তাঁরা। সেই সমীকরণ মেনেই, অনুব্রত এ দিন সিপিএম-কংগ্রেস বোঝাপড়া বা বিজেপিকে যত না আক্রমণ করেছেন, তার চেয়ে ঢের বেশি বিঁধেছেন গাঁওতাকে। তৃণমূলের একাংশ মানছেন, কর্মীদের সাহস যোগাতেই এই হুঙ্কার।
অনুব্রত যখন বক্তব্য রাখছেন তখন মঞ্চে উপস্থিত এলাকার বিদায়ী বিধায়ক তথা তৃণমূল প্রার্থী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্লকের যুগ্ম সভাপতি গৌতম মণ্ডল-সহ এলাকার নেতাকর্মীরা। একের পর হুমকিতে দলের ভাবমূর্তি নিয়ে জনমানসে কী নেতিবাচক বার্তা যাচ্ছে না? আশিসের মন্তব্য, ‘‘গাঁওতা ক্রমাগত হুমকি দিয়ে চলেছে। এ দিনের বক্তব্য তার প্রতিবাদ মাত্র।’’ গাঁওতার হুমকির বিরুদ্ধে কমিশনের কাছে নালিশ জানানোর কথাও বলেছেন তিনি।
অন্য দিকে, গাঁওতা সম্পাদক রবিন সোরেন বলেন, ‘‘কে বা কারা কেন হুমকি দিচ্ছে তা সকলের জানা। এ দিন সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনেই প্রকাশ্যে হুমকি দেওয়া হয়েছে। উনি নিজেই বলছেন, কোনও মানুষকে ভয় দেখানোর অধিকার কারও নেই। আবার তিনিই বলছেন গাঁওতার বিষ দাঁত ভেঙে দেব!’’ রবিনের অভিযোগ, ‘‘আসলে তৃণমূল বুঝতে পারছে ওদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। তাই ভয় পেয়ে হুমকির আশ্রয় নিচ্ছে।’’
বস্তুত, ভোট মরসুমে একের পর এক ‘বেফাঁস’ মন্তব্য করে অনুব্রত নির্বাচন কমিশনের নজরে এসেছেন আগেই। সে বীরভূমের ময়ূরেশ্বরে বিজেপি ভোট-প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্যই হোক আর ‘গুড়-জলে ভোট’ করানোর দাওয়াই হোক। কিছু দিন আগে এক কর্মিসভায় অনুব্রত বলেন, ‘‘আমি বলে দিচ্ছি, সাঁইথিয়ায় ৬০-৭০ হাজার লিড চাই। কোনও বাঘের আওয়াজ হবে না, কোনও সিংহের আওয়াজ হবে না! আপনারা পুরসভায় ভোট করেছেন, পঞ্চায়েত ভোট করেছেন। তার কৌশল জানেন। কোনও চিন্তা করবেন না!’’
বিরোধী নেতাদের একাংশ বলছেন, এটা শুধু কেষ্টর একার কথা নয়। এমন কৌশল নিচ্ছেন তৃণমূলের অন্য নেতারাও। নন্দীগ্রামের তৃণমূল প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারী যেমন এর মধ্যে বলেছেন, তাঁদের হাতে লোকজন আছে। কী ভাবে ভোট করাতে হয়, তাঁরা জানেন!
শাসক দলের তরফে যত এমন সব মন্তব্য বাড়ছে, ততই দু’বছর আগের স্মৃতি তাড়া করছে বিরোধীদের! তাদের অভিযোগ, সে বার কমিশনের পর্যবেক্ষকদের নানা উপায়ে ‘হাতে রেখে’, কেন্দ্রীয় বাহিনীকে প্রায় দর্শক করে রেখে ইচ্ছেমতো ভোট করিয়ে নিয়েছিল তৃণমূল। পুরভোটে দায়িত্ব থাকে রাজ্য নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য প্রশাসনের উপরে। কাজেই সেই ভোট নিরপেক্ষ হবে, এমন আশা প্রায় ছিলই না বিরোধীদের। কিন্তু বিধানসভা ভোটের আগের ছবি তাদের নতুন করে চিন্তায় ফেলছে। তাঁদের প্রশ্ন, এ বারেও একই ঘটনা ঘটবে না তো?
কমিশনের তরফে অবশ্য বারেবারেই আশ্বাসবাক্য শোনানো হচ্ছে। ‘‘কাজের কাজ কী হয় দেখার সেটাই’’— বলছেন জেলা সিপিএমের এক নেতা।