তৈরি: পুরুলিয়ার ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে মঞ্চ। ছবি: সুজিত মাহাতো
এক সময়ে পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ জনপদে উড়ত ফরওয়ার্ড ব্লকের বাঘ আঁকা পতাকা। পালাবদলের সাত বছর পরে ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে সেই পুরুলিয়ায় একটি পঞ্চায়েতও দখল করতে পারেনি ফব। ঝুলিতে এসেছে শুধু পঞ্চায়েতের ২৬টি আসন ও পঞ্চায়েত সমিতিতে চারটি আসন। জেলা সম্মেলনে সম্পাদক থেকে সভাপতি হওয়ার পরেই বিজেপিতে যোগ দেন প্রাক্তন ফব সাংসদ নরহরি মাহাতো। একের পর এক আঘাত আসা সেই পুরুলিয়া জেলাতেই আজ, শুক্রবার থেকে শুরু হতে যাচ্ছে ফব-র তিন দিনের অষ্টাদশ রাজ্য সম্মেলন।
ফব-র দীর্ঘদিনের রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষের দেহ যে পুরুলিয়ার মাটিতে শায়িত, সেখানে এই প্রথমবার দলের রাজ্য সম্মেলন হচ্ছে। দলের এই দুর্দিনে নেতৃত্ব সংগঠনে নতুন করে রক্ত সঞ্চালনের জন্য কী বার্তা দেন, সে দিকে তাকিয়ে কর্মীরা। শুক্রবার পুরুলিয়ার ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে প্রকাশ্য সমাবেশের মধ্যে দিয়ে সম্মেলনের শুরু হচ্ছে।
দলের রাজ্য সম্পাদক নরেন চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘বামফ্রন্ট মানে শুধু সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক বা কয়েকটি দল নয়। বামফ্রন্ট মানে জীবন-জীবিকার লড়াই। আমরা মনে করি দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে নিয়ে কখনও বাম ঐক্য হতে পারে না। বর্তমান সময়ে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তি ও অগণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বৃহত্তর বাম ঐক্যের প্রয়োজন। এই সম্মেলনে আমরা কর্মীদের কাছে ও সাধারণ মানুষের কাছে সেই বার্তাই দেব।’’
তবে, সম্মেলনের আগের দিন বৃহস্পতিবার ফব-র জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর এক নেতা বলেন, ‘‘বামফ্রন্টের বড় শরিক সিপিএমকে পরিষ্কার করতে হবে, তাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে থাকবেন, নাকি বামফ্রন্টে থাকবেন। কারণ, ২০১৬-র মতো কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএম নির্বাচনী সমঝোতা করলে, আমাদের একলা চলার রাস্তাই নিতে হবে। সম্মেলনে এই বিষয়টিও গুরুত্ব পাবে। গত বিধানসভা ভোটে দেখেছি, বাঘমুণ্ডিতে আমরা কংগ্রেসকে ভোট দিলেও আমাদের দখলে থাকা জয়পুর আসনটি হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। কারণ ওই বিধানসভার কংগ্রেসের বেশির ভাগ ভোট আমরা পাইনি।’’
অক্টোবরে আড়শার কাঁটাডিতে অনুষ্ঠিত দলের অষ্টাদশ জেলা সম্মেলনে জেলা সভাপতি হন প্রাক্তন সাংসদ নরহরি মাহাতো। তার পরেই তিনি বিজেপিতে যোগ দেন। এ দিন নরহরিবাবু বলেন, ‘‘১৯৭৭ সাল থেকে পুরুলিয়া সংসদে ফরওয়ার্ড ব্লক লড়াই করছে। ১৩ বার এই আসনটি ফরওয়ার্ড ব্লক লড়েছে। কিন্তু, ২০১৬ সালে দলীয় নেতৃত্ব রাজ্যের যে এলাকায় দলের সংগঠন রয়েছে, সেখানকার আসনটিই কংগ্রেসকে তুলে দিলেন। এই দ্বিচারিতা ফব-র নিচুতলার কর্মীরাও মেনে নিচ্ছেন না।’’
দলের বর্তমান জেলা সভাপতি বীরসিংহ মাহাতো বলছেন, ‘‘রাজনীতিতে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকে। ২০১৬ সালের বাঘমুণ্ডি বিধানসভা কেন্দ্রের নির্বাচন ছিল সে রকমই একটা ঘটনা। আমরা কংগ্রেসকে সমর্থন করিনি, সিপিএম রাজ্যস্তরে করেছিল। আমরা রাজ্য থেকে প্রতীক আনলেও তৃণমূলকে হারানোর লক্ষ্যে পরে মেনে নিই। কিন্তু, দল বদলে বিজেপিতে যাইনি।’’
বর্তমানে যাই হোক, এই জেলায় ফব-র পত্তন কিন্তু ইতিহাস। কংগ্রেস ছেড়ে সুভাষচন্দ্র বসু ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনের পর বিহারের রামগড়ে তিনি ডাক দিয়েছিলেন আপোস-বিরোধী সম্মেলনের।
সেই সম্মেলনের প্রস্তুতিতে সুভাষচন্দ্র ১৯৩৯ সালের ৯ ডিসেম্বর পুরুলিয়ায় আসেন। জেলার ইতিহাস গবেষক দিলীপ গোস্বামী জানাচ্ছেন, সুভাষচন্দ্র তৎকালীন মানভূম ঘুরে ৪০টি সভা করেছিলেন। তারপরে অশোক ঘোষ এই জেলায় কার্যত মাটি কামড়ে সংগঠন গড়েছিলেন। মৃত্যুর পরে তাঁর দেহ শায়িত রয়েছে আড়শার সুইসা নেতাজি আশ্রমের মাটিতে।
তবে, অতীতে এই জেলায় ফব-র বিভিন্ন শাকা সংগঠনের রাজ্য সম্মেলন হলেও, দলের রাজ্য সম্মেলন হিসেবে কখনও বাছা হয়নি। তাই দলের কঠিন সময়ে এই জেলাকে বেছে নেওয়ায় উচ্ছ্বসিত দলের কর্মীরা।