আকুতি: নিহত নিরঞ্জন গোপের বাবা মহানন্দ গোপ। নিজস্ব চিত্র
কী অপরাধ করেছিল, যে গুলি করে মারতে হবে— এই প্রশ্নই তুলছেন নিহতদের পরিজনেরা। মঙ্গলবার নিহত বিজেপি সমর্থক পুরুলিয়ার জয়পুরের ঘাঘরা গ্রামের যুবক নিরঞ্জন গোপ ও ছোটকা গ্রামের বৃদ্ধ দামোদর মণ্ডলের দেহ বাড়িতে পৌঁছনোর পরেই ক্ষোভ উগরে দেন তাঁদের পরিজনেরা। নিরঞ্জনের বাবা মহানন্দ গোপ, দামোদরবাবুর ছেলে সুভাষ মণ্ডলের দাবি, ‘‘পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠন দেখতে যাওয়া নিরীহ মানুষগুলোকে পুলিশ গুলি করে মারল। এর দায় তো পুলিশ ও প্রশাসনকেই নিতে হবে। সরকারকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।’’ পুলিশ সুপার আকাশ মাঘারিয়া কোনও বিষয়েই মন্তব্য করতে চাননি।
সোমবার জয়পুরের ঘাঘরা পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠনের সময়ে বিজেপি কর্মীদের জমায়েত থেকে গোলমাল হওয়ায় পুলিশ গুলি চালায় বলে অভিযোগ।
ঘটনাস্থলেই মারা যান নিরঞ্জন। আহত চার জনের মধ্যে দামোদরবাবু পুরুলিয়া হাসপাতালে মারা যান। তাঁদের দু’জনের কোমর ও নীচে দু’টি করে গুলি লেগেছে। আহত তিন জনের মধ্যে দু’জন পুরুলিয়া হাসপাতালে ভর্তি। এক জনকে অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়েছে।
সোমবার রাতেই নিহত দু’জনের দেহ ময়না-তদন্তের পরে গ্রামে নিয়ে যান বিজেপি কর্মীরা। একটি ক্লাব ঘরে রাখা ছিল। এ দিন দেহগুলি নিহতদের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরিবারগুলিকে সান্ত্বনা দিতে যান রাজ্য বিজেপি নেতা সায়ন্তন বসু, বিজেপির জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী। সায়ন্তন বলেন, ‘‘দিল্লির নেতৃত্বকে সোমবারই পুরো ঘটনাটি জানিয়েছি। ছবিও পাঠানো হয়েছে।’’ বিদ্যাসাগর বলেন, ‘‘আমরা দুই পরিবারের পাশে রয়েছি।’’
ঘটনার পর থেকেই থমথমে দু’টি গ্রাম। নিরঞ্জন ট্রাক্টর রেখে পঞ্চায়েতে গিয়েছিলেন। আর গ্রামে গ্রামে চিঁড়ে ফেরি করা দামোদরবাবু সোমবার আর কাজে বেরোননি। গ্রামের ছেলে বিজেপির অদীপ মণ্ডল পঞ্চায়েত প্রধান হতে পারে শুনে তিনি পাড়ার কয়েকজনের সঙ্গে সকালেই পঞ্চায়েত অফিসে গিয়েছিলেন।
তাঁর সঙ্গে সোমবার ঘটনাস্থলে ছিলেন পড়শি রাসবিহারী মণ্ডল, জিতেন্দ্রনাথ মণ্ডল, বিমল মণ্ডলেরা। তাঁরা বলেন, ‘‘পুলিশ সকাল থেকেই আমাদের পঞ্চায়েত থেকে কিছুটা দূরে থামিয়ে দেয়। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু, ভিতরে কী হচ্ছিল, বুঝতে পাচ্ছিলাম না।’’
তিনি জানান, আড়াই ঘণ্টা পরে এক বিজেপি সদস্যা বাইরে বেরিয়ে এসে জানান, সমস্ত বিরোধী ও নির্দলেরা মিলিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা দেখানোর পরেও বিজেপির থেকে প্রধান করতে দেওয়া হচ্ছে না। তখনই লোকজনের মধ্যে উত্তেজনা ছড়ায়। লোকজন ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ আটকে দেয়। সামনে থাকা লোকজনের উপরে লাঠিচার্জ করে। কাঁদানে গ্যাসের সেলও ফাটায়।
তাঁর কথায়, ‘‘তারপরেই কী হল জানি না, এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে শুরু করল পুলিশ। অনেক গুলি চলেছে। মাথা ঠিক ছিল না। যে যেদিকে পারি, ছুটে পালাই।’’
দামোদরের চার মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়েরা খবর পেয়ে শ্বশুরবাড়ি থেকে এসেছিলেন। তাঁর দুই মেয়ে পিনি, বেলা, পুত্রবধূ সুনীতা বলেন, ‘‘সুস্থ সবল মানুষটা কৌতূহলে পঞ্চায়েতে গিয়েছিল। কিন্তু, গুলি খেয়ে মরবে ভাবতে পারা যাচ্ছে না।’’ নিরঞ্জনের বাবা মহানন্দ বলেন, ‘‘নিরঞ্জনের দু’টি ছেলে-মেয়েকে কী করে মানুষ করব?’’
আতঙ্কের ছাপ এ দিনও দেখা গিয়েছে পঞ্চায়েত অফিস সংলগ্ন এলাকায়। ঘাঘরা-গোকুলডি রাস্তা থেকে হাইস্কুল, প্রাইমারি স্কুল, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র পার করে পঞ্চায়েত ভবন। এ দিন দেখা যায়, হুগলির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ঈশানী পাল এবং পুরুলিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপারেশন) ধৃতিমান সরকার ঘটনাস্থলে তদন্ত করছেন।
রাজ্য পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘লাঠি চালিয়ে, কাঁদানে গ্যাসের সেল ফাটিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলেই ভিড় পাতলা হয়ে যেত। উত্তেজিত জনতাকে সামলাতে তেমনটাই সাধারণত করা হয়। কিন্তু, ঘাঘরায় কী এমন হয়েছিল যে গুলি চালাতে হল?’’