শোকার্ত: হাতির হানায় মৃত মঙ্গল বাউরির (ইনসেট) পরিবার। নিজস্ব চিত্র
কাজে যাওয়ার সময় জানিয়েছিলেন, ফেরার পথে স্ত্রীর জন্য দাঁতে ব্যথার ওষুধ নিয়ে আসবেন। ওষুধ কিনেও ছিলেন। কিন্তু বাড়ি এসে আর ওষুধ দেওয়া হল না। খবর এল, গ্রামের কাছে দিঘিরপাড় এলাকায় হাতির হানায় মৃত্যু হয়েছে মঙ্গল বাউরির। এ ভাবে হঠাৎ স্বামীকে হারানোর শোক কোনও ভাবেই কাটিয়ে উঠতে পারছেন না মঙ্গলের স্ত্রী রেখা। শোক নেমেছে হাতির হানায় আর এক মৃত তুলসি বটব্যালের বাড়িতেও।
চার মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে সংসার ছিল মঙ্গলের। বড় ও মেজো মেয়ের বিয়ে হয়েছে কয়েক বছর আগে। বাকি দুই মেয়ে স্কুল ছাত্রী। মঙ্গল রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। বুধবার রেখা বলেন, “স্বামী নেই, মানতে পারছি না। দুই মেয়েকে নিয়ে কী ভাবে আমি বাঁচব?’’ তার বড় মেয়ে সুজাতা জানান, রাজমিস্ত্রির কাজে বড়জোড়ার বিভিন্ন জায়গায় যেতে হত মঙ্গলকে। ক’দিন ধরেই দাঁতের যন্ত্রণায় কাবু রেখা। মঙ্গলবার তালানজুড়িতে বাড়ি ঢালাইয়ের কাজে যাওয়ার সময় মঙ্গল জানিয়েছিলেন, ফেরার পথের স্ত্রীর জন্য ওষুধ কিনে আনবেন। কিন্তু মঙ্গলবার অনেক রাত পর্যন্ত তিনি না ফেরায় বাড়ির লোকজন ফোন করেন। তিনি ফোন না ধরায় চিন্তা বাড়ে। নানা জায়গায় তাঁরা খোঁজখবর শুরু করেন। শেষে গভীর রাতে পুলিশের মাধ্যমে বাড়িতে খবর আসে, মঙ্গল মারা গিয়েছেন। সুজাতা বলেন, “আমি শ্বশুরবাড়িতে ছিলাম। বাড়ি থেকে ফোন করে ভোর রাতে আমাকে বাবার মৃত্যুর খবর জানানো হয়। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে আসি। এমন ঘটবে, কোনও দিন ভাবিনি।’’
তার কয়েক ঘণ্টার পরেই সংগ্রামপুর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে হাতি যে এক জনের প্রাণ নেবে, কেউ ভাবেননি। বাড়ির দরজা থেকে শুঁড় দিয়ে টেনে হাতি আছড়ে মারে ঝরিয়ার বৃদ্ধা তুলসি বটব্যালকে। তাঁর নাতি সুজয় বলেন, “মাঝ রাতে বাড়ির পাঁচিল ভাঙার শব্দ পেয়ে ঠাকুমা দরজা খুলে বেরোয়। আমরা অন্যঘরে ছিলাম। হঠাৎ ঠাকুমার আর্তনাদ শুনে দৌড়ে বেরিয়ে দেখি বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে হাতি, পাশে ঠাকুমা রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে। হইচই শুরু করায় কিছুক্ষণ পরে হাতিটি পালিয়ে যায়।”
সংগ্রামপুরের যুবক সুধীরকুমার পরামানিক বলেন, “জঙ্গলের পথ ধরেই আমাদের নিত্য যাতায়াত। হাতির হানায় আর কত মৃত্যু হবে? পথের দু’পাশে আগাছার জঙ্গল। কোথায় হাতি থাকবে, বোঝা দায়। অবিলম্বে রাস্তার দু’পাশের ঝোপ সাফ করা হোক।”
ঝরিয়ার বাসিন্দা সুব্রত বটব্যালের অভিযোগ, “এতগুলি হাতি আমাদের গ্রাম লাগোয়া জঙ্গলে রয়েছে, অথচ বন কর্মীরা ঠিকমতো নজরদারি চালাচ্ছে না। তাঁদের নজর থাকলে এমন পরিণতি হত না। বন দফতর হাতি মোকাবিলার জন্য গ্রামবাসীকে হুলা ও ডিজেল দিক।’’
এ দিন বিকেলে বাঁকুড়া মেডিক্যালের মর্গ থেকে ময়না-তদন্তের পরে দেহ দু’টি গ্রামে আসে।
বিজেপি যুব মোর্চার বিষ্ণুপুর সাংগঠনিক জেলা সাধারণ সম্পাদক তথা বড়জোড়ার বাসিন্দা সোমনাথ কর বলেন, “ঝরিয়ার ওই বৃদ্ধা মাটির বাড়িতে থাকতেন। এই ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল হাতি কবলিত এলাকার কাঁচাবাড়ির বাসিন্দারা নিরাপদ নন। অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় তাঁদের বাড়ি বানিয়ে দেওয়া হোক।’’ বড়জোড়ার তৃণমূল বিধায়ক অলক মুখোপাধ্যায় এ দিন হাতির হানায় মৃতদের পরিবারে গিয়ে সমবেদনা জানান। অলক বলেন, “গ্রামে হাতির হামলা ঠেকাতে বন দফতর যাতে আরও বেশি করে উদ্যোগী হয়, তা নিয়ে আলোচনা করেছি।”
প্রশাসনের তরফে তিন দফা সতর্কতা জানিয়ে এ দিন বিকেল থেকে বড়জোড়া ও বেলিয়াতোড় এলাকায় প্রচারপত্র বিলি শুরু করা হয়েছে।