বাঁকুড়ার উত্তরবাড় গ্রামে কাদা খেলায় মেতে বাসিন্দারা। — নিজস্ব চিত্র।
দশমী মানেই মনখারাপের বিদায় আর বছরভরের অপেক্ষার শুরু। মা দুর্গার প্রতিমা নিরঞ্জনের পরেই বিজয়া দশমীর শুভেচ্ছা জানিয়ে একে অপরকে আলিঙ্গন করে নেওয়া হয়। কোলাকুলি, মিষ্টিমুখ, ছোটদের প্রণাম এবং গুরুজনদের আশীর্বাদে দুর্গাপুজোর শেষ দিনটি পালিত হয় ঘরে ঘরে। কিন্তু দশমীর এই চেনা ছবি দেখা গেল না বাঁকুড়ার জয়পুর ব্লকের উত্তরবাড় গ্রামে। সেখানে পুজোর শেষ দিনে গ্রামবাসীরা হাতে তুলে নিলেন কাদামাটি।
উত্তরবাড় গ্রামের এক প্রান্তে রয়েছে ঝগড়াইভঞ্জনী দেবীর মন্দির। মা দুর্গা এই রূপেই এখানে পূজিতা। প্রতি বছর পুজো উপলক্ষে কয়েক দিনের জন্য যেন আড়াল ভাঙে অখ্যাত উত্তরবাড়ের। আশপাশের বহু গ্রাম থেকে এই মন্দিরের সামনে জড়ো হন মানুষ। কাদার খেলায় মেতে ওঠেন সকলে।
প্রাচীন রীতি মেনেই আজও দশমীর দিন কাদা ছোড়াছুড়ি খেলা হয় উত্তরবাড় গ্রামে। সাড়ে ৩০০ বছর ধরে এই রেওয়াজ চলে আসছে। যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রাচীন মল্ল রাজাদের ইতিহাস।
মঙ্গলবার পুজোর শেষ দিনে দুপুর থেকেই ভিড় বাড়তে শুরু করেছিল উত্তরবাড়ে। প্রতি বছরের মতো কাদা খেলতে এ বারেও পার্শ্ববর্তী কুলসায়ের, নতুনগ্রাম, বৈতল, ঈষানপাড়া, কোলেপাড়া, বাবুয়াপাড়া, ময়নাপুর-সহ বেশ কিছু গ্রাম থেকে লোক এসেছিলেন। মন্দিরের সামনে ফাঁকা অঞ্চলে মাটির বাধ দিয়ে এলাকার পুকুরগুলির জল একত্রিত করেন উদ্যোক্তারা। তার পর হাঁটুসমান কাদাজলে নেমে শুরু হয় উদ্যাপনের পালা। একে অপরের গায়ে কাদা মাখিয়ে, কাদাজল ছিটিয়ে দশমীর শুভেচ্ছা জানান।
সাড়ে ৩০০ বছর আগে এই এলাকায় মল্ল রাজাদের শাসন ছিল। কথিত আছে, সেই সময় নাকি নিকটবর্তী বর্ধমানের রাজা, কোতুলপুরের রাজা এবং চন্দ্রকোনার রাজাদের সঙ্গে মল্ল রাজারা প্রায়ই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তেন। স্থানীয় সন্ধিপুরের মাঠ হয়ে উঠেছিল যুদ্ধক্ষেত্র। মল্লদের রাজধানী বিষ্ণুপুর থেকে ওই মাঠে যাতায়াতের পথেই পড়ত উত্তরবাড় গ্রাম। মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহ এক বার যুদ্ধে যাওয়ার পথে সেখানে একটি বটগাছের নীচে বৃষ্টি আর কাদায় এক বালিকাকে খেলা করতে দেখেছিলেন। বালিকা নাকি মাঝেমধ্যেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছিল। রাজার বিশ্বাস জন্মায়, বালিকা সাধারণ নয়। দেবী দুর্গাই আসলে বালিকার রূপ ধারণ করে তাঁকে দেখা দিয়েছেন। রাজা তৎক্ষণাৎ মানত করেছিলেন, যুদ্ধে জয় পেলে ওই স্থানে তিনি ঝগড়াইভঞ্জনী দুর্গার মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন। মন্দির স্থাপিত হয় যথাসময়ে। দেবীর সংহার মূর্তি গড়ে মহা সমারোহে শুরু হয় দুর্গাপুজো। প্রথম বছরের পুজোয় দশমীর দিন নাকি মল্লরাজ স্বয়ং সৈন্যসামন্ত নিয়ে কাদাখেলায় মেতে উঠেছিলেন। সেই থেকে চলে আসছে দশমীতে কাদাখেলার রীতি।