Anubrata Mondal

বীরভূমেই বেশি বিক্ষোভের মুখে ‘দিদির দূত’, কেষ্ট না থাকাই কি ফ্যাক্টর? খুঁজল আনন্দবাজার অনলাইন

‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ কর্মসূচি নিয়ে মানুষের কাছে গিয়ে রাজ্যে বীরভূম জেলাতেই সবচেয়ে বেশি বিক্ষোভের মুখে পড়ছেন তৃণমূলের নেতানেত্রীরা। কেন? জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল না থাকাই কি কারণ?

Advertisement

তরুণিমা মণ্ডল

বোলপুর শেষ আপডেট: ২৬ জানুয়ারি ২০২৩ ১৩:১০
Share:

অনুব্রত মণ্ডলের সশরীরে না থাকাই কি এই ‘নির্ভয়’ বিক্ষোভের কারণ? — ফাইল ছবি।

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়! এই প্রবাদবাক্য ঘিরেই এখন আড়াআড়ি ভাগ বীরভূম। প্রশ্ন হল, বাঘ না থাকলে কি ভয়ও উবে যায়? ‘দিদির দূত’-এরা যে ভাবে বীরভূমের গ্রামে গ্রামে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের মুখে পড়ছেন, তাতে ফিরহাদ হাকিম বর্ণিত ‘বাঘ’-এর অনুপস্থিতিই কারণ কি না, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে রবি-ভূমে।

Advertisement

তৃণমূলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল গরুপাচার মামলায় জেলে। তাঁর সশরীরে না থাকাই কি এই ‘নির্ভয়’ বিক্ষোভের কারণ? না-থেকেও কেষ্টই কি ‘ফ্যাক্টর’ বীরভূমের মাটিতে?

তৃণমূলের প্রণীত ‘দিদির সুরক্ষা কবচ’ প্রকল্প অনুযায়ী ‘দিদির দূত’ যাবেন মানুষের বাড়ি বাড়ি। শুনবেন অভাব-অভিযোগের কথা। জানাবেন সরকারি পরিকল্পনা এবং প্রকল্পের কথা। গোটা রাজ্যের পাশাপাশি বীরভূমেও এই লক্ষ্যে ‘মেগা জনসংযোগ’ কর্মসূচি শুরু হয়েছে। তার পর থেকেই বিভিন্ন জেলায় ‘দূত’-দের ক্ষোভ-বিক্ষোভ-অভিযোগ-অনুযোগের মুখে পড়তে হচ্ছে। কিন্তু খতিয়ান খতিয়ে দেখলে দেখা যাচ্ছে, গোটা রাজ্যের মধ্যে বীরভূমেই ওই ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হচ্ছে।

Advertisement

গত ১৩ জানুয়ারি ‘দিদির দূত’ হয়ে তৃণমূল সাংসদ শতাব্দী রায় গিয়েছিলেন রামপুরহাটের মাড়গ্রামে। সেখানে তারকা সাংসদকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখান গ্রামবাসীরা। দাবি ছিল রাস্তার। সেই শুরু। তার পর থেকে বীরভূমের একাধিক গ্রামে ‘দিদির দূত’-দের সামনে পেয়ে ক্ষোভ জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা। গ্রামীণ গণক্ষোভের সামনে কোনও দিন পড়েছেন বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় আবার কোনও দিন মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ। কোনও দিন দলের কোনও যুবনেতা। কোনওদিন স্থানীয় অন্য কোনও বিধায়ক বা সাংসদ।

বীরভূম জেলায় মোট ১১টি বিধানসভা আসন। ২০২১-এর ভোটে তার মধ্যে ১০টিই পেয়েছিল তৃণমূল। একমাত্র দুবরাজপুর আসনটি প্রায় ৪ হাজার ভোটে জিতেছিল বিজেপি। জেলায় তৃণমূল একাই পেয়েছিল সাড়ে ৫১ শতাংশ ভোট। বিধানসভা ধরে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে রামপুরহাট, হাসন, মুরারই, নানুর— যেখানে যেখানে গ্রামবাসীদের বিক্ষোভের মুখে পড়েছেন ‘দিদির দূত’, সেখানেই গত বিধানসভায় অনায়াসে জয় পেয়েছিল তৃণমূল। তা হলে কী এমন হল যে, মানুষ জনপ্রতিনিধিদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করলেন?

বীরভূমে বিজেপির জেলা সভাপতি ধ্রুব সাহার মতে, ‘‘মানুষের দীর্ঘ দিনের আক্ষেপ আর ক্ষোভ একদিন না একদিন তো বার হওয়ারই ছিল। কিন্তু এত দিন বীরভূমের মানুষ মুখ খুলতে পারছিলেন না ওই অনুব্রতের জন্য। মানুষ এখন মুখ খুলছেন। ভোটেও তাঁরা জবাব দেবেন।’’ প্রায় একই অভিমত সিপিএমের বীরভূম জেলা সম্পাদক গৌতম ঘোষের। তাঁর কথায়, ‘‘শাসক দলের উপরে মানুষের রাগ, ক্ষোভ ধীরে ধীরে বাড়ছে। কত দিনই বা ভয় দেখিয়ে চুপ করে রাখা যাবে? উন্নয়নের নামে আসলে যা হয়েছে, সেটা উপলব্ধি করতে পারছেন মানুষ। এ সবই তার প্রতিফলন। আগামীতে এমন আরও অনেক কিছুই দেখা যাবে।’’ আর কংগ্রেস নেতা মিল্টন রশিদের বক্তব্য, ‘‘শাসকদলের নেতারা হঠাৎ করে এসে মাটিতে পা ফেলতে গেলে এমন কাণ্ড তো ঘটবেই। কারণ, এত দিন চেয়ারে বসে থেকেই তাঁরা ‘উন্নয়ন হয়েছে, উন্নয়ন হয়েছে’ বলে চিৎকার করেছেন। সেগুলো যে সব মিথ্যা ছিল, সেটা এখন প্রমাণ হচ্ছে।’’

প্রত্যাশিত ভাবেই তৃণমূল নেতৃত্ব এ কথা মানতে রাজি নন। শাসকদলের যুক্তি, দলের নেতা-কর্মীরা সরকারি কর্মসূচি এবং সেগুলির অগ্রগতি সরজমিনে দেখতে মানুষের দুয়ারে যাবেন, এমন ‘সরাসরি জনসংযোগ’ প্রকল্প এই প্রথম। তাই অনুব্রত আছেন কি নেই, তা বিষয় নয়। তৃণমূলের যুক্তি, মানুষের অভাব-অভিযোগের কথা শুনতেই এই কর্মসূচি শুরু হয়েছে। নেতাদের কাছে পেয়ে মানুষ সেটাই জানাচ্ছেন। বিক্ষোভ নয়, তৃণমূলের দাবি, মানুষ দাবিদাওয়ার কথা জানাচ্ছেন। সেটাকে ‘বিক্ষোভ’ বলে দাগিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। বীরভূম জেলা তৃণমূলের মুখপাত্র মলয় মুখোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘সাধারণ মানুষ তৃণমূলের সঙ্গেই ছিলেন। তৃণমূলের সঙ্গেই আছেন। একটা মানুষ সব প্রকল্প পেয়ে যাবেন, এটা তো হয় না। তাই মানুষ তাঁদের অভাব-অভিযোগের কথা বলেছেন। সে কারণেই তো তৃণমূলের এই পরিকল্পনা। ফলে এগুলোকে বিক্ষোভ বলা ভুল।’’

নেতা বা জনপ্রতিনিধিদের গাড়ি থামিয়ে সাধারণ মানুষ কাজকর্ম নিয়ে সটান প্রশ্ন করছেন, এ দৃশ্যের সঙ্গে ‘কেষ্টর বীরভূম’ খুব একটা পরিচিত ছিল না। সেই সূত্রেই পরের প্রশ্নের অবতারণা—অনুব্রতের উপস্থিতির কারণেই কি এত দিন বীরভূমবাসী নীরব ছিলেন? সেটা সত্যি হলে আগামী দিনে তৃণমূলের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। কারণ, বীরভূমের ‘বাঘ’ অনুব্রতের আশু জেলমুক্তি হবে কি না, তা কেউই বলতে পারছেন না। তার সুযোগে বিরোধীরা এই জনবিক্ষোভকে সম্বল করে পঞ্চায়েত ভোটের সময় মাঠে নামতে চাইছেন। তার কি কোনও প্রতিফলন বীরভূমে দেখা যাবে? তৃণমূল নেতৃত্ব তা মনে করেন না। বরং তাঁদের পাল্টা যুক্তি, মানুষের ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকলে তা বেরোবেই। মানুষের চাহিদার ব্যাপারে হাতেকলমে জানতেই এই কর্মসূচি। আগামী দিনে মানুষের দাবিদাওয়া সম্পর্কে তৃণমূল স্তরের নেতাদের ‘সরাসরি’ অভিজ্ঞতা হচ্ছে। তার পর তা সমাধানের প্রক্রিয়া শুরু হবে।

জেলা তৃণমূলের একাংশের বক্তব্য, অনুব্রতের সাংগঠনিক ক্ষমতার কারণে ক্ষোভ-বিক্ষোভ এত দিন এ ভাবে প্রকাশ্যে আসেনি। কিন্তু অনুব্রত জেলার সবচেয়ে বড় নেতা হলেও দল আরও বড়। মূলত সেই কারণেই রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিংহ, ডেপুটি স্পিকার আশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী এবং লাভপুরের বিধায়ক অভিজিৎ সিংহ এখন ‘সমন্বয়’ করে জেলা তৃণমূলের সাংগঠনিক কাজকর্ম দেখছেন।

গ্রামের সাধারণ মানুষ নেতা-তারকাকে দেখে মুগ্ধ হওয়ার পরিবর্তে নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথা জোরগলায় বলতে শুরু করে দিচ্ছেন কেন? প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক প্রশান্ত রায়ের মতে, ‘‘কোনও জেলায় এই ধরনের ঘটনার ঘনঘটার পিছনে একটা কারণ হতে পারে রাজনৈতিক অর্থনীতি (পলিটিক্যাল ইকনমি)। একটু খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে, যে-যে এলাকায় বিক্ষোভের ঘটনা বেশি হচ্ছে, সেখানে অনুব্রত মণ্ডলের অনুপস্থিতিতে এলাকার রাজনৈতিক অর্থনীতিতে কোনও বড় বদল এসেছে কি না।’’ পাশাপাশিই প্রবীণ অধ্যাপকের বক্তব্য, ‘‘অনুব্রত নিজের যে ভাবমূর্তি তৈরি করেছেন, তা মূলত ভয়ের উপর নির্ভর করে। কিছু মানুষ হয়তো তাঁকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করেন, কিন্তু আদতে তাঁর প্রতি ভয়-ভক্তির যে মায়াজাল, তা মূলত ভয়নির্ভর। যে কোনও দিন কেটে যেতে পারে।’’

তবে এই বীরভূমেই এমন এলাকাও আছে, যেখানে বিধায়ককে ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেছেন গ্রামবাসীরা। তা হলে কি সেখানে অনুব্রত ‘ফ্যাক্টর’ নন? লাভপুরের তৃণমূল বিধায়ক অভিজিৎ সিংহ বলছেন, ‘‘মানুষের সঙ্গে সারা বছর থাকি। মুখ্যমন্ত্রীর কথা মানুষের কানে পৌঁছে দেওয়াই আমার কাজ। তা যত্ন করে করার চেষ্টা করি। এখানে একমাত্র ফ্যাক্টর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।’’

অভিজিতের বক্তব্যে দলীয় লাইনেরই প্রতিধ্বনি, ‘‘আমাদের নেতা, সাংসদ, বিধায়কদের ঘিরে বিক্ষোভ হচ্ছে বলে যা বলা হচ্ছে, তা আদৌ বিক্ষোভ নয়। মানুষ তাঁদের দাবিদাওয়ার কথা জানাচ্ছেন। এটাই তো দলের লক্ষ্য।’’ অভিজিতের মতে, ঐতিহাসিক ভাবে বীরভূমের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর নয়। বরং ভূপ্রকৃতির কারণেই অভাবের চিহ্ন পদে পদে প্রকট। তাই চাহিদা আর জোগানের ফারাক বরাবরই ছিল। সীমিত অর্থনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সরকার সেই ফারাক যতটা সম্ভব কমানোর চেষ্টা করছে। সেই পরিসরেই মানুষ মনের কথা, দাবিদাওয়ার কথা, চাহিদার কথা বলছেন শাসকদলের নেতাদের। অভিজিতের দাবি, ‘‘মানুষ জানেন, সিপিএম বা বিজেপির কাছে চাহিদার কথা জানিয়ে কোনও লাভ নেই। তাই তৃণমূলই ভরসা।’’

একটা সময় ছিল, যখন সিপিএম সাংসদ রামচন্দ্র ডোম নিজের লোকসভা কেন্দ্রের কোনও গ্রামে গেলে পুষ্পবৃষ্টি হত। মুখে মুখে চাউর হয়ে যেত— ডাক্তারবাবু এসেছেন! তিলধারণের জায়গা থাকত না আশপাশে। আজ সেই বামও নেই, রামেরও সাংসদপদ গিয়েছে। সিপিএমের পলিটব্যুরো সদস্য তথা বীরভূমের প্রাক্তন সাংসদ বিষয়টিকে এতটা সহজ করে দেখতে রাজি নন। তিনি বলছেন, ‘‘অনুব্রত মণ্ডলের না থাকা গণতন্ত্রের পক্ষে মঙ্গল। কিন্তু সমস্যাটা একা অনুব্রত নন। তৃণমূল সরকার যে ভাবে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পের নাম দিয়ে লুটে খাওয়ার অনুষ্ঠান শুরু করেছে, তাতে বেশি দিন মানুষ মুখ বুজে থাকবেন না। বীরভূমের মানুষ তো আরও দ্রুত মুখ খুলবেন! সেটাই স্বাভাবিক। বিপুল দুর্নীতি আর বেলাগাম দুর্বৃত্তায়ন সহ্য করতে করতে মানুষের এখন দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। গ্রামে গিয়ে তা-ই টের পাচ্ছেন তৃণমূল নেতা, সাংসদ, তারকারা।’’ তবে পাশাপাশিই সিপিএম পলিটব্যুরোর প্রথম দলিত সদস্যও কিন্তু মানছেন, অনুব্রত একটা ‘ফ্যাক্টর’।

এখন প্রশ্ন, যে কেষ্টর ‘সাংগঠনিক দক্ষতা’র উপর ভর করে বীরভূমে বছর বছর ভোটে জিতে এসেছে তৃণমূল (গত পঞ্চায়েত ভোটেও এই জেলায় নিরঙ্কুশ ছিল শাসকদল), তাঁর অনুপস্থিতিতে কি তাতে টোল পড়তে পারে? সেই কারণেই কি মুখ খুলতে শুরু করেছেন সাধারণ মানুষ? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে অবশ্য অপেক্ষা করতে হবে পঞ্চায়েত ভোটের ফলঘোষণা পর্যন্ত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement