অসহায়: ধান বাঁচাতে মরিয়া চেষ্টা। পাত্রসায়রের আন্দ্রা গ্রামে। (ডানে) কেটে রাখা ধান ঘরে তোলার আগেই ডুবেছে বৃষ্টিতে। বিষ্ণুপুরের মড়ার গ্রামে। ছবি: তারাশঙ্কর গুপ্ত ও শুভ্র মিত্র
আমপানের ফলে টানা দেড় দিনের বৃষ্টিতে বাঁকুড়া জেলায় লক্ষাধিক চাষির মাথায় হাত পড়ল। কৃষি দফতরের প্রাথমিক হিসেবে, ফসলের ক্ষয়ক্ষতির অঙ্ক ছাড়াল কয়েকশো কোটি। বোরো ধান থেকে তিল, আনাজ, পান, আম— ক্ষতির হাত থেকে বাদ যায়নি কিছুই।
বাঁকুড়ার উপ-কৃষি অধিকর্তা সুশান্ত মহাপাত্র বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে জানা যাচ্ছে, আমপানের প্রভাবে জেলা জুড়ে ফসলে ক্ষতির পরিমাণের অঙ্ক প্রায় ৩৪৬ কোটি টাকা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এক লক্ষ ৪০ হাজার কৃষক। জেলা জুড়ে ১৮ হাজার হেক্টর বোরো ধান জমি, ১৫ হাজার হেক্টর তিল জমি জলের তলায়। ১, ১৭০ হেক্টর জমির আনাজ ক্ষতির মুখে পড়েছে। ৭৬ হেক্টর জমির পান বরজে ক্ষতি হয়েছে। ফলের বাগান নষ্ট হয়েছে প্রায় এক হাজার ৬০০ হেক্টর।’’ তিনি জানান, ধান ও তিল চাষিরা যাতে শস্যবিমার আওতায় ক্ষতিপূরণ পান, সে চেষ্টা শুরু হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট রাজ্যকে পাঠানো হয়েছে।
অন্য দিকে ভারী বৃষ্টি না হওয়ায় কিছুটা রক্ষা পেয়েছে পুরুলিয়া। এই জেলায় আনাজ চাষে ক্ষতি প্রায় হয়নি বলেই দাবি করছে জেলা কৃষি দফতর। তবে ঝালদা, আড়শা ব্লকে বৃষ্টিতে জমিতে জল জমে যাওয়াতে আনাজের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন চাষিরা।
বাঁকুড়া আবহাওয়া দফতর সূত্রে খবর, বুধবার আমপানের প্রভাবে বাঁকুড়ায় বৃষ্টি হয়েছে ৫১.৪ মিলিমিটার। বিষ্ণুপুর ব্লকের উলিয়াড়া ও রাধানগর পঞ্চায়েতের একাধিক কৃষি খেতে বিঘার পরে বিঘা বোরো ধান জলে ডুবছে। বিষ্ণুপুর ব্লকের ধানগড়া, জন্তা, ডিহর, বিদ্যাসাগর, মেডুয়া, মেটালের মতো অনেক জায়গাতেও একই পরিস্থিতি। বৃহস্পতিবার সকালে ধানগড়ার জলে ডুবে থাকা বড় মাঠে পাকা ধান দেখিয়ে চাষি হারাধন পরামানিকের আক্ষেপ, “এ বছর ভাল ধান হয়েছিল। ভেবেছিলাম ধান বিক্রি করে পাওয়া টাকায় ধারদেনা শোধ করে জমিতে মিনি সাব-মার্সিবল পাম্প বসাব। সব শেষ হয়ে গেল!’’ পরিচিত, বন্ধুবান্ধবের কাছে ধার দেনা করে ১৫ বিঘা জমিতে বোরো ধান গিয়েছিলেন জন্তার বাসিন্দা যাদব কুণ্ডু। তিনি বলেন, “চার-পাঁচ দিন সময় পেলেই ধান কেটে নিতে পারতাম। আচমকা আমপান এসে সব শেষ করে দিল। এই ধানের লাভের উপরেই নির্ভর করছে পরের বছরের চাষ। বোধহয় জমি ফেলেই রাখতে হবে।”
বিষ্ণুপুর মহকুমা কৃষি দফতর সূত্রে জানা যায়, মহকুমার ছ’টি ব্লকের মধ্যে জয়পুর, কোতুলপুর ও বিষ্ণুপুরে ধান পরে লাগানো হয়েছে বলে প্রায় ৭০ শতাংশ বোরো ধান মাঠেই থেকে গিয়েছে। সোনামুখী ও পাত্রসায়র ব্লকে বোরো ধান কাটা হয়েছে মাত্র ৩৫ শতাংশ। জয়পুর ও কোতুলপুরে যা ধান চাষ হয়েছে, তার ৭০ শতাংশ মাঠেই পড়ে আছে।
বিষ্ণুপুর মহকুমা সহ-কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) হেমন্ত নায়েক বলেন, “মহকুমায় মোট বোরো ধান চাষ হয়েছিল ৫২,০৪১ হেক্টর। তার মধ্যে মাঠ থেকে ধান তোলা হয়েছে সাড়ে ২৪ হাজার হেক্টর। গড়ে প্রায় ২৭ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান মাঠেই আছে। বেশির ভাগটাই ক্ষতির মুখে পড়েছে।”
কৃষি দফতর সূত্রের খবর, পুরুলিয়াতে আমপানের প্রভাবে বুধবার গড় বৃষ্টি হয়েছে ৩৪ মিলিমিটার। তবে বেশি বৃষ্টি হয়েছে বাঁকুড়া লাগোয়া ব্লকগুলিতেই। জেলায় সব থেকে বেশি বৃষ্টি হয়েছে পুঞ্চা ব্লকে। ওই ব্লকে বৃষ্টির পরিমাণ ৪৬.৪ মিলিমিটার। মানবাজার, হুড়া, কাশীপুরের মতো বাঁকুড়া লাগোয়া ব্লকগুলিতে বৃষ্টির গড় ছিল ৪২ মিলিমিটার। সব থেকে কম বৃষ্টি হয়েছে পাড়া ব্লকে। সেখানে বৃষ্টি হয়েছে মাত্র ১৭.১ মিলিমিটার।
আমপানের প্রভাবে পুরুলিয়াতে ৭০ মিলিমিটার বৃষ্টির সম্ভাবনা ছিল বলে আগেই জানিয়েছিল কৃষি দফতর। তার অর্ধেক হওয়াতে আনাজ চাষে ক্ষতি হয়নি বলেই জানাচ্ছেন জেলার সহকারী কৃষি অধিকর্তা সুশান্ত দত্ত।
তিনি বলেন, “যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, তাতে জমিতে জল বেশিক্ষণ দাঁড়াবে না। আনাজ চাষে ক্ষতির খবর আমাদের কাছে আসেনি।” রঘুনাথপুর ১ ব্লকের রক্ষতপুর গ্রামের উৎপল মাজি, কাশীপুরের গগনাবাইদ গ্রামের নিতাই মাজি প্রমুখ চাষি বলেন, “জমিতে আগাম নালা কেটে রাখার কারণে বৃষ্টিতে জল দাঁড়ায়নি। আনাজের ক্ষতিও এড়ানো গিয়েছে।’’
তবে ঝালদা ১ ব্লকের পুরানো ঝালদা গ্রামের চাষি মথুর কুইরি, আড়শা ব্লকের জামবাদ গ্রামের সুরজিৎ মাজি, গৌরদাগ গ্রামের মিঠুন রায়েরা জানাচ্ছেন, টানা বৃষ্টিতে জমিতে জল জমেছে। মাঠে থাকা উচ্ছে, শাক, টোম্যাটো, কুমড়োর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।