রাজ্যে পালাবদলের পর থেকেই ভোটে বামেদের রক্তক্ষরণ চলছিলই। কিন্তু এ বার লোকসভা ভোট-ব্যাঙ্কে যেন ধস নেমেছে। পাঁচ বছর আগে পুরুলিয়ায় লোকসভা ভোটে দ্বিতীয় স্থানে থাকা বামফ্রন্ট এ বার নেমে গিয়েছে চতুর্থ স্থানে! তৃণমূল অভিযোগ করছিল, বামেদের মদতেই বিজেপির ভোট-বৃদ্ধি। জেলা বাম নেতৃত্বের নির্বাচন-উত্তর পর্যালোচনাতেও দেখা গিয়েছে তারই ছায়া। তাই দলবিরোধী কাজে যুক্ত থাকার অভিযোগে পার্টি সদস্যদের একাংশের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন সিপিএমের পুরুলিয়া জেলা নেতৃত্ব।
সিপিএমের পুরুলিয়ার জেলা সম্পাদক প্রদীপ রায়ের কথায়, ‘‘পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরেই দলীয় স্তরে ফল পর্যালোচনা শুরু হয়েছিল। দেখা গিয়েছে, যে সব কর্মীরা দলবিরোধী কাজে যুক্ত হয়ে পড়েছেন, দলের স্বাস্থ্য ও শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।”
সিপিএমের একটি সূত্রের খবর, পঞ্চায়েত ভোটের পর থেকে বিজেপি, এমনকি তৃণমূলকেও সমর্থন জোগানোর জন্য জেলার প্রায় পঞ্চাশ জন পার্টি সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে দু-তিন জন এরিয়া কমিটির সদস্যও রয়েছেন। সূত্রের খবর, লোকসভা ভোটের ফল বিশ্লেষণে ওই তালিকায় আরও কয়েকজন নেতা-কর্মীর নাম ওঠার কথা শোনা যাচ্ছে।
এক বছর আগে পঞ্চায়েত ভোটে পুরুলিয়া জেলায় বিজেপির উত্থানের সঙ্গেই বামফ্রন্টের নিস্তেজ হওয়ার ছবিটা প্রকট হয়েছে। জেলার মধ্যে একটিও পঞ্চায়েত সমিতি দখলে আসেনি বামেদের। এমনকি জেলা পরিষদের একটিও আসনও পায়নি তারা। বড় শরিক হিসাবে বেশি ধাক্কা খেয়েছে সিপিএম।
সিপিএম সূত্রে খবর, পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরেই ফল নিয়ে কাটাছেঁড়ায় বসেছিলেন জেলা নেতৃত্ব। তারপরেই পর্যায়ক্রমে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল প্রায় ৩০ জন পার্টি সদস্যকে। লোকসভা ভোটের মুখে বহিষ্কার করা হয় আরও ন’জনকে। আর লোকসভা ভোটের পরেই শাস্তির খাঁড়া নামে আরও দশ জনের উপরে। এক বছরের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ জন পার্টি সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার করা সাম্প্রতিক অতীতে দেখেনি পুরুলিয়া জেলা সিপিএম। বহিষ্কৃতদের সংখ্যা বেশি মূলত পাড়া, পুরুলিয়া ২, কাশীপুর, বলরামপুর, বাঘমুণ্ডি ও রঘুনাথপুর ব্লক এলাকায়।
ক্ষমতা হারানোর পর থেকে জেলায় সিপিএমের সদস্য সংখ্যা অনেক কমেছে। বহু পুরনো কর্মী সদস্যপদ নবীকরণও করাননি। জেলা সিপিএমের একটি সূত্র জানাচ্ছে, দল যখন ক্ষমতায় ছিল সেই সময়ে শেষ দিকে এই জেলায় পার্টি সদস্য ছিল কুড়ি হাজারের কিছু বেশি। জোনাল ও লোকাল কমিটি মিশে গিয়ে বর্তমানে ৫৪টি এরিয়া কমিটিতে সদস্য সংখ্যা নেমে এসেছে ১১ হাজারের কাছাকাছি।
এই পরিস্থিতিতে কেন পার্টি সদস্যদের বহিষ্কার করা হচ্ছে? দলের এক জেলা নেতার সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, ‘‘কথায় আছে— দুষ্ট গরুর থেকে শূন্য গোয়াল ভাল। ওঁরা দলে থেকে সংগঠনেরই ক্ষতি করছিলেন। তাই রেখে লাভ কী?’’
সিপিএমের একটি সূত্র জানাচ্ছে, পঞ্চায়েত ভোটের থেকেও লোকসভা ভোটে দলের ফল খারাপ হয়েছে। বহু বুথে দলের ‘নিশ্চিত’ ভোটও ইভিএমে যায়নি। এমন বুথও বেশ কয়েকটি রয়েছে, যেখানে বাম প্রার্থী একটিও ভোট পাননি। পঞ্চায়েতে যেখানে বামেরা পেয়েছিল (জেলা পরিষদের আসনগুলির নিরিখে) ১ লক্ষ ৮৯ হাজার ভোট, লোকসভা ভোটে সেটাই কমে এসেছে সাড়ে ৬৮ হাজারে। মাত্র সাড়ে পাঁচ শতাংশ ভোট পেয়ে জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে বামফ্রন্ট প্রার্থী বীর সিং মাহাতোর। এটা এক প্রকার অন্তর্ঘাত বলেই মনে করছেন নেতৃত্বের একাংশ। তাই বহিষ্কারের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে ইঙ্গিত দিচ্ছেন তাঁরা।
জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দীননাথ লোধার কথায়, ‘‘প্রতিটি এলাকা ধরে পর্যালোচনা হবে। নির্বাচনে দলের এরিয়া কমিটির সদস্যরেই শুধু নন, জেলা কমিটির সদস্যদের ভূমিকাও কী ছিল, তা-ও বিশদে খতিয়ে দেখা হবে।”
তবে সিপিএমের নেতা-কর্মীদের একাংশের ব্যাখ্যা, শুধু পুরুলিয়া জেলাতেই নয়, এ বার সারা রাজ্য তো বটেই, দেশেই অন্যত্রও বামেদের ফল খারাপ হয়েছে। তীব্র মেরুকরণের রাজনীতি ও তৃণমূলের অপশাসন থেকে মুক্তি পেতে দলমত নির্বিশেষে ভোটারদের বড় অংশ ঝুঁকেছে বিজেপির দিকে।
এরপরেও অবশ্য হারানো জমি পুনরুদ্ধারের বিষয়ে আশাবাদী পুরুলিয়ার সিপিএম নেতৃত্ব। বাহাত্তর সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গ টেনে জেলা সম্পাদক দাবি করছেন, ‘‘ওই নির্বাচনে বামেদের ভরাডুবি হয়েছিল। হেরে গিয়েছিলেন খোদ জ্যোতি বসুও। তার পাঁচ বছরের মধ্যে কিন্তু যুক্তফ্রন্ট গড়ে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বামেরা।”