বিধানসভা নির্বাচনে বাঁকুড়া জেলার ফলাফলে দলনেত্রী যে রুষ্ট, নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে রাজ্য তৃণমূলের নেতা নেত্রীরা জেলায় এসে বারবার তা স্পষ্ট করে দিয়ে গিয়েছেন। জেলা সফরে এসে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সাংগঠনিক পদে বড়সড় রদবদল আনতে পারেন বলে দলের মধ্যে জল্পনাও শুরু হয়েছিল। বড় রদবদল অবশ্য হয়নি। তবে মঙ্গলবার মুকুটমণিপুরের বারোঘুটুতে দলীয় বৈঠকে জেলায় ছ’জনের নতুন কোর কমিটি গড়ে দিয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ওই কমিটির হাতেই সঁপে দিয়েছেন মমতা।
আর এখান থেকেই নতুন করে জল্পনা দানা বাঁধতে শুরু করেছে। দলের একাংশের মতে, কোর কমিটি গড়ে দিয়ে জেলা সভাপতি অরূপ খাঁয়ের ক্ষমতা আংশিক খর্ব করা হয়েছে। আগেও জেলার কোর কমিটির সভাপতি ছিলেন অরূপবাবু। এ বারও নতুন কোর কমিটিতে তাঁকেই সভাপতি করা হয়েছে। কিন্তু কোর কমিটির যে সুর মমতা বেঁধে দিয়েছেন, সেখানেই দু’টি কোর কমিটির কাজ-কারবারে অনেক ফারাক দেখতে পাচ্ছেন দলের নেতারা।
দলের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, আগের কোর কমিটির কোনওদিন বৈঠকই হয়নি। সভাপতিই সব দেখতেন। বাকিদের কোনও ভূমিকাও দলের কর্মীরা সে ভাবে দেখতে পাননি। তবে এ বার দলীয় বৈঠকে মমতা নির্দেশ দিয়েছেন, জেলায় দলীয় যে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে হবে কোর কমিটিতে আলোচনা করেই। এ ছাড়া গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে দলের কোনও পঞ্চায়েতে যাতে আর অনাস্থা না আসে তাও দেখতে বলে গিয়েছেন নেত্রী। সেই সঙ্গে নেত্রী আগামী পঞ্চায়েত ভোটকে মাথায় রেখে কোনও রকম দ্বন্দ্ব যাতে মাথাচাড়া না দেয়, তা দেখতে ওই কমিটিকে বিশেষ ভাবে তৎপর হতে বলেছেন। কমিটির সদস্যদের নিয়মিত বৈঠকেও বসতে বলেছেন তিনি।
জেলা তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “এর মানেই হল কারও একার সিদ্ধান্তে আর দল চলবে না। কেউ যদি দল-বিরোধী কাজ করেন, জেলা সভাপতি চান বা না চান, কোর কমিটির সদস্যেরা চাইলে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবেন।” সভাপতি অরূপবাবু অবশ্য কোনও রকম বিতর্কে কান দিতে নারাজ। তাঁর সাফ কথা, “দলীয় নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে ভাবে বলবেন, আমরা সে ভাবেই চলব। কোর কমিটির সদস্যেরা একসঙ্গে মিলিত ভাবে দায়িত্ব পালন করবেন। এ নিয়ে জল্পনা হওয়ার কী আছে?”
ঘটনা হল, রাজ্যে পালাবদলের পর থেকেই বাঁকুড়া জেলা জুড়ে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব চলছে। একের পর এক পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতিতে দলীয় প্রধান বা সভাপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা হচ্ছে। দলের কর্মীদের মধ্যে ঝুটঝামেলা, মারামারি লেগেই রয়েছে। দল বিড়ম্বনায় পড়লেও জেলা নেতৃত্বকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব রুখতে সে ভাবে কড়া ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। দলেরই একাংশের মতে, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে নরম মনোভাবের পরিনাম বিধানসভা নির্বাচনে ভোগ করতে হয়েছে।
গত বিধানসভা নির্বাচনে জেলা সভাপতি অরূপবাবুর বিরুদ্ধেই নির্দল প্রার্থী হয়ে ভোটে লড়েন ওন্দার প্রাক্তন তৃণমূল নেতা অশোক চট্টোপাধ্যায়। তৃণমূলের তারকা প্রার্থী সোহম চক্রবর্তী বড়জোড়ায় হারায় এলাকার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে দায়ী করেন দলের বহু নেতা। এ বার ভোটে হারেন তৃণমূল প্রার্থী প্রাক্তন মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দীপালি সাহা, মিনতি মিশ্র, শুভাশিস বটব্যাল। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বই ওই প্রার্থীদের হারার মূল কারণ বলে অনেকে মনে করেন। দলের সভাপতি হিসেবে দায় গিয়ে পড়ে সভাপতির ঘাড়ে। শীর্ষ নেতৃত্বও ভাল
ভাবে নেয়নি। পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলছে। দলের এক রাজ্য নেতার কথায়, “দলের অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব যে জায়গায় পৌঁছেছে, তাতে জেলায় এমন কোনও নেতা নেই যিনি একক ভাবে শক্ত হাতে তা সামাল দিতে পারেন। পঞ্চায়েত ভোটের আগে এই বিপদ এড়াতেই ছ’জনের কোর কমিটি গড়েছেন নেত্রী।”
নতুন কোর কমিটিতে সভাপতি অরূপবাবু ছাড়াও রয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামল সাঁতরা, জেলা সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তী, বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। জেলার এই পরিচিত মুখেরা ছাড়াও তালড্যাংরার বিধায়ক সমীর চক্রবর্তী ও রানিবাঁধের বিধায়ক জ্যোৎস্না মান্ডিকেও কমিটিতে রেখেছেন দলনেত্রী। এ বার জেলায় তৃণমূলের দ্বন্দ্ব থামে কি না, এখন সেটাই দেখার।