প্রশিক্ষণে ব্যস্ত নানুরের খুজুটিপাড়া চণ্ডীদাস কলেজের ছাত্রীরা। —সোমনাথ মুস্তাফি
পরিবারের সম্মতি ছিল না। ভাল মনে নিতে পারেননি গ্রামের কিছু মানুষও। তবু সব কিছু নস্যাৎ করে এগিয়ে এসেছিল ওরা। দেখতে দেখতেই ক্যারাটে শিখে সবার নজর কেড়েছেন নানুরের খুজুটিপাড়া চণ্ডীদাস কলেজের ছাত্রী খাদিজা সুলতানা, পূজা মাহাতোরা।
সম্প্রতি ওই কলেজে ‘জাতীয় সেবা প্রকল্পে’ ছাত্রীদের ক্যারাটে প্রশিক্ষণ দিতে উদ্যোগী হন কলেজ কর্তৃপক্ষ। চলার পথে কোনও রকম হেনস্থার শিকার হলে ছাত্রীরাই যাতে তার মোকাবিলা করতে পারে, সেই লক্ষ্যেই ওই পরিকল্পনা নেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কয়েক দিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র মুখো হতে দেখা যায়ি কাউকে। হাল ছেড়ে দেওয়ার মুখে ছাত্রীদের কাছ থেকেই সব শুনে হতবাক হয়ে যান কলেজ কর্তৃপক্ষ।
ছাত্রীদের মুখ থেকেই তাঁরা জানতে পারেন, মেয়েদের ক্যারাটে শেখাটা প্রায় প্রতিটি পরিবারেই না-পছন্দের। মেয়েদের পড়াশোনা করে বিয়ে, বড় জোর চাকরির বাজারে যোগ্য হয়ে ওঠার মতো কিছু প্রাচীন ধারণা নিয়েই চলছিল পরিবারগুলি। তাই ক্যারাটের ক্লাসে ছেলেদের মতো মেয়েদের শারীরিক কসরত করাটা ছিল অধিকাংশের ভাবনার অতীত। গ্রামের কিছু মানুষও বিষয়টি ভাল চোখে দেখছিলেন না। তাই ইচ্ছা সত্ত্বেও ছাত্রীরা প্রথম দিকে ওই প্রশিক্ষণে যোগ দিতে পারেনি।
অগত্যা পথে নামতে হয় কলেজ কর্তৃপক্ষকেই। তাঁরা ছাত্রীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বোঝান, আত্মরক্ষার জন্য ছাত্রীদের ক্যারাটে শেখাটা কতটা জরুরি। কলেজ কর্তৃপক্ষের দাবি, ওই দাওয়াইয়ে কাজ হয়। কারণ, প্রতিটি পরিবারেই মেয়েদের উত্যক্ত হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। তার পর থেকেই ভিড় বাড়তে থাকে ক্যারাটের ক্লাসে।
বর্তমানে প্রতি শনিবার ৫০ জন ছাত্রী ওই প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। শেখানে হচ্ছে ‘শোতকান ক্যারাটে’। অনুমোদন মিলেছে ‘ওয়ার্ল্ড ক্যারাটে ফেডারেশন’ নামক সংস্থার থেকে। শিক্ষার্থীদের অন্যতম পালিটা গ্রামের বিএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী খাদিজা সুলতানা, কড্ডার প্রিয়া চৌধুরী, হাড়মুড়ের পুজা মাহাতো, মঙ্গলকোটের জিবন্নেসা খাতুনরা বলেন, ‘‘প্রথম দিকে ক্যারাটে প্রশিক্ষণের কথা তুলতেই বাবা-মায়েরা সরাসরি না করে দিয়েছিল। তার পর স্যারেরা গিয়ে বোঝাতেই সম্মতি মিলেছে।’’
ক্যারাটে প্রশিক্ষণে প্রাথমিক আপত্তি থাকার কথা মেনে নিয়েছেন ছাত্রীদের অভিভাবক বদরে আলম, মজনিনআরা সুলতানা, রবীন্দ্রনাথ মাহাতোরা। তাঁরা বলেন, ‘‘পরিবারে তো বটেই গ্রামেও মেয়েদের ক্যারাটে শেখার চল ছিল না। তাই গ্রামের লোকেরা কে কী চোখে দেখবে বলে প্রথম দিকে মেয়েদের ক্যারাটে শেখানোর ব্যাপারে আমাদের খুব একটা মত ছিল না। কিন্তু যখন বুঝলাম, ক্যারাটে শিখে রাখলে মেয়েরা নিজেরাই ছোটখাটো বিপদ থেকে নিজেদের উদ্ধার করতে পারবে, তখন আর দু’বার ভাবিনি। চলার পথে বিপদ তো কম নেই।’’
প্রশিক্ষক দেবাশিস প্রামাণিক জানান, সামান্য কয়েক দিনের প্রশিক্ষণেই ছাত্রীরা অনেকখানি আত্মবিশ্বাস অর্জন করে ফেলেছে। অন্য দিকে, ওই বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষক জানান, নানা সংস্কার বশে প্রথম দিকে মেয়েদের ক্যারাটে প্রশিক্ষণে সম্মতি ছিল না অধিকাংশ অভিভাবকেরই। গুরুত্ব বোঝার পরে এখন তাঁরাই আগ্রহ নিয়ে মেয়েদের প্রশিক্ষণে পাঠাচ্ছেন।