আর্ত: সন্তান কোলে নিয়ে কানাই মাজির (ইনসেটে) স্ত্রী। নিজস্ব চিত্র
এক মাস আগেই বাড়ি এসে সদ্যোজাত ছোট মেয়েকে দেখে গিয়েছিলেন। স্ত্রীকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, আবার দ্রুত ফিরবেন। আর ফেরা হল না ছত্তীসগঢ়ের মাওবাদী উপদ্রুত সুকনা জেলায় কর্মরত কানাই মাজির (২৮)। মঙ্গলবার বিকেলে সুকনার কিস্তারাম থানার পালডি গ্রামের অদূরে মাওবাদীদের গুলিতে নিহত হন সিআরপির কোবরা বাহিনীর ২০৮ নম্বর ব্যাটেলিয়নের ওই জওয়ান। খবর আসার পরেই শোকের ছায়া নেমেছে পুরুলিয়ার রঘুনাথপুরে কানাইয়ের গ্রাম লছিয়ায়।
ছত্তীসগঢ় পুলিশের আইজি (এসআইবি) সুন্দর রাজ বুধবার বলেন, ‘‘পালডি এলাকায় মাওবাদী দমনে অভিযান চালাচ্ছিল সিআরপি-র কোবরা বাহিনী ও পুলিশ। সেই সময়েই মাওবাদীদের সঙ্গে সংঘর্ষে গুলিতে জখম হন দুই কোবরা জওয়ান। তাঁদের মধ্যে কানাই মাজির মৃত্যু হয়। আর এক জওয়ানের চিকিৎসা চলছে।”
মঙ্গলবার রাতে সেই মর্মান্তিক খবর রঘুনাথপুর থানার পুলিশের মারফত কানাইয়ের বাড়িতে পৌঁছয়। কান্নার রোল ওঠে। শোকস্তব্ধ গ্রাম দেহ ফেরার অপেক্ষায় প্রহর গনতে শুরু করে। জেলা পুলিশ জানাচ্ছে, প্রথমে সিআরপি তাদের জানিয়েছিল, ছত্তীসগঢ় থেকে হেলিকপ্টারে সরাসরি গ্রামে দেহ আনা হবে। সেই মতো লছিয়ার পাশেই রামকানালিতে একটি বেসরকারি শিক্ষক শিক্ষণ কলেজের সামনের মাঠে হেলিপ্যাড তৈরি করা হয়। পরে অবশ্য ছত্তীসগঢ় থেকে রাঁচীতে হেলিকপ্টারে দেহ আনা হয়। তার পরে সেখান থেকে সড়কপথে রাতে কানাইয়ের কফিনবন্দি দেহ নিয়ে গ্রামে পৌঁছন সিআরপি জওয়ানেরা। শ্রদ্ধা জানাতে গিয়েছিলেন জেলা পরিষদের সভাধিপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়, পুলিশ সুপার এস সেলভামুরুগান প্রমুখ।
এ দিন সকাল থেকেই গ্রামবাসী ভিড় করেছিলেন কানাইয়ের বাড়ির বাইরে। পরিচিতজনেরা কানাইয়ের পরিবারকে সান্ত্বনা দেন। গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, থমথমে মুখে বাড়িতে বসে নিহত জওয়ানের বাবা দিলীপ মাজি, মা মীনাদেবী। এক মাসের মেয়েকে নিয়ে হাউহাউ করে কাঁদছিলেন কানাইয়ের স্ত্রী পাপিয়া। পাশে ছিল আড়াই বছরের মেয়ে অলিভিয়া।
পড়শিরা জানান, বছর চারেক আগে বিয়ে হয়েছিল কানাইয়ের। এক মাস আগে দ্বিতীয় সন্তান হওয়ায় পাপিয়া দুর্গাপুরে বাপের বাড়িতে ছিলেন। মঙ্গলবার রাতে খবর পাওয়ার পরে দুর্গাপুর থেকে তাঁকে লছিয়া গ্রামে আনা হয়। দিলীপবাবু জানাচ্ছেন, ছোটবেলা থেকেই কানাইয়ের সেনাবাহিনীতে যাওয়ার ঝোঁক ছিল। কলেজে পড়ার সময়ে এনসিসি-র প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে সিআরপি-তে যোগ দেন। প্রথম ‘পোস্টিং’ ছিল দুর্গাপুরে। পরে জম্মু-কাশ্মীরে বদলি হন। বছর তিনেক আগে যান ছত্তীসগঢ়ের সুকমায়।
কৃষিজীবী দিলীপবাবু বলেন, ‘‘মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা নাগাদ ছেলের এক সহকর্মী ফোন করেন। ওর পায়ে গুলি লেগেছে বলেই ফোন কেটে দেন। তারপর থেকে উৎকণ্ঠায় ছিলাম। রাতে পুলিশ খবর দেয় সব শেষ।’’ পুত্রশোকে কার্যত পাথর মীনাদেবী। পাপিয়া কোনও রকমে জানান, মঙ্গলবার দুপরে ফোনে তাঁর সঙ্গে এক বার স্বামীর কথা হয়েছিল। সেই সময়ে কানাই জানিয়েছিলেন, রাতে আবার ফোন করবেন। পাপিয়ার কথায়, ‘‘রাতে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনেই ওঁকে ফোন করেছিলাম। ফোনটা বেজে যায়। পরে রায়পুরে কন্ট্রোল রুমে বারবার ফোন করি। কিন্তু পরিচয় দিয়ে কথা বলার সময়েই দেখি সকলে কী ঘটেছে তা এড়িয়ে যাচ্ছেন। তখনই মনটা কু-ডাক দিয়েছিল। কিন্তু মানুষটা যে নেই, মন তা মানতে চাইছিল না।’’
অঝোরে কাঁদার মাঝেই পাপিয়া বলে চলেন, ‘‘বড় মেয়েকে ডাক্তারি পড়ানোর ইচ্ছা ছিল ওর। তার আগেই সংসারটা ভেঙে গেল। সরকার হয়তো ক্ষতিপূরণের টাকা দেবে। কিন্তু আমাদের দু’জনের এক সঙ্গে দেখা ছোট ছোট আশা, স্বপ্নগুলো তো টাকা দিয়ে ফিরবে না।” একই সঙ্গে তাঁর প্রশ্ন, ”কেন মাওবাদী সমস্যা কড়া হাতে সরকার দমন করতে পারছে না? উল্টে মাওবাদীদের হাতেই পরপর মৃত্যু হচ্ছে জওয়ানদের।”
গ্রামে এলেই বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটাতেন কানাই। বছরে দু’-তিন বার ছুটি নিয়ে কয়েকদিনের জন্য গ্রামে ফিরতেন। ছেলেবেলার সহপাঠী বিকাশ মাজি, পাশের বাড়ির বাসিন্দা পেশায় সিভিক ভলান্টিয়ার সুশান্ত মণ্ডলেরা বলেন, ‘‘অ্যাডভেঞ্চারের প্রতি টান ছিল বলে কোবরা বাহিনীতে যায় কানাই। এ ভাবে চলে যাবে ভাবিনি!”