উল্টোরথের রাতেই প্রতিপক্ষকে বুঝে নেবে দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। —নিজস্ব চিত্র।
লম্বা শিং বাগিয়ে ধেয়ে আসছে একটি ষাঁড়। ধারালো নখ আর ঠোঁট বাগিয়ে প্রতি আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ‘গরুড়’। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে একে অপরের দিকে। এক কিলোমিটার ব্যবধান রেখে রীতি মেনে লড়াই হবে নিজেদের মধ্যে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মাঝের এক কিলোমিটার পরিসর থাকবে পুলিশের দখলে। উল্টোরথের রাতে ‘এঁড়ে গরু’ আর ‘গরুড়’-এর এমন ধুন্ধুমার লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত জিত কার হবে, মঙ্গলবার তারই প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন মল্লভূমবাসী।
বাঁকুড়ার প্রাচীন মল্লগড় বিষ্ণুপুরের বয়স কমপক্ষে হাজার বছর। মল্ল রাজধানীর উৎসব-অনুষ্ঠান সবেতেই রয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্যের ছোঁয়া। বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্যবাহী উৎসব উল্টোরথ তেমনই। যে দিনের উন্মাদনা ছাপিয়ে যায় রথের উন্মাদনাকেও। রীতি মেনে ‘এঁড়ে গরু’ আর ‘গরুড়’-এর প্রতীকী লড়াইয়ে মেতে ওঠেন আপামর বিষ্ণুপুরবাসী।
কিন্তু উল্টোরথের রাতে কেন এমন অদ্ভুত রীতির চল? ১৬৬৫ খ্রিষ্টাব্দে রানি শিরোমণির ইচ্ছাপূরণে শহরের মাধবগঞ্জ এলাকায় সুবিশাল মাকড়া পাথরের মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন তৎকালীন মল্লরাজা বীর সিংহ। মন্দিরে রাধা-মদনগোপাল জিউয়ের মূর্তি প্রতিষ্ঠার পর মল্ল রাজাদের অর্থানুকূল্যেই মাধবগঞ্জে শুরু হয় রথ উৎসব। পরে রাধা-মদনগোপাল জিউয়ের মন্দিরের আদলে বিশাল পিতলের রথ তৈরি করে রথ উৎসবের সূচনা করেন মল্লরাজ। এই রথে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার বদলে রাধা-মদনগোপাল জিউয়ের মূর্তি চাপিয়ে নগর পরিক্রমার রীতি চালু হয়। পরবর্তী সময়ে এই রথ ‘এগারোপাড়ার রথ’ হিসাবে পরিচিতি পায়। পাশাপাশি, রথের প্রতীক হয়ে ওঠে ‘এঁড়ে গরু’। বিষ্ণুপুরে তখন থেকেই রথের মেলার তুলনায় অধিক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে রাধা-মদনগোপাল জিউয়র উল্টোরথের উৎসব। সাড়ে তিনশো বছর পেরিয়ে গেলেও মাধবগঞ্জের রথ উৎসবে সেই ধারাই বজায় রয়েছে। অন্য দিকে, তুলনায় নবীন হলেও মাধবগঞ্জের এগারোপাড়ার রথকে সমানে সমানে টেক্কা দিয়ে চলেছে বিষ্ণুপুরের কৃষ্ণগঞ্জের আটপাড়ার রথ। রীতি মেনে আটপাড়ার রথে সওয়ার হন রাধালাল জিউ, কৃষ্ণ রায় ও গোবিন্দ রায় জিউ নামে তিন দেবমূর্তি। আটপাড়ার রথের প্রতীক গরুড়।
দশকের পর দশক ধরে চলে আসা রীতি মেনে ঐতিহ্যবাহী এগারোপাড়া এবং আটপাড়ার দু’টি রথই উল্টোরথের সন্ধ্যায় শোভাযাত্রা সহযোগে বার হয় বিষ্ণুপুরের রাজপথে। রাতভর দু’টি রথ শহরের রাজপথে শোভাযাত্রা সহকারে ঘুরে ভোরের দিকে ফেরে নিজ নিজ মন্দিরে। দু’টি রথে নিজ নিজ প্রতীক থাকে। বিশাল বিশাল ‘কাটআউট’ তৈরি করে শোভাযাত্রার আয়োজনে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার জন্য চলে প্রতিযোগিতা।
দুই রথের আলোকসজ্জা, বাদ্যযন্ত্র, জনসমাগম— সবেতেই একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার সেই লড়াই ধীরে ধীরে বিষ্ণুপুরে ‘এঁড়ে গরু ও গরুড়ের লড়াই’ হিসাবে পরিচিতি পায়। এগারোপাড়া রথের উদ্যোক্তা তথা বিষ্ণুপুরের পুরপ্রধান গৌতম গোস্বামী বলেন, “একটা সময় ছিল, যখন দুই রথের উদ্যোক্তাদের মধ্যে প্রবল রেষারেষি হত। উল্টোরথের সময় এক পাড়ার লোক অন্য পাড়ায় যেতেন না। একে অপরের প্রতীককে হেয় করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতেন। এখন সেই রেষারেষি নেই। বরং বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে সুস্থ প্রতিযোগিতা হয় দুই রথের আয়োজনে। ‘এঁড়ে গরু বনাম গরুড়ের লড়াই’ এখন বিষ্ণুপুরের মানুষের কাছে এক আলাদা উন্মাদনার নাম।” আটপাড়া রথের উদ্যোক্তা রবিলোচন দে বলেন, “রীতি মেনে মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই লড়াইয়ে নামবে আমাদের ‘গরুড়’ এবং এগারোপাড়ার ‘এঁড়ে গরু’। এই লড়াই এখন নিছকই প্রতীকী লড়াই। মঙ্গলবার রাতভর সেই লড়াই তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবেন মল্লভূমের মানুষ।’’