ভাইফোঁটার সময় বাড়ির বাইরেই দিন কাটে নানুরের কুমিরা গ্রামের ঢাকিদের। —নিজস্ব চিত্র
চার বছর ধরে একমাত্র ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেওয়া হয়নি নানুরের কুমিড়ার বাণী দাসের। তিন বছর ধরে ভাইকে ফোঁটা দেওয়া হয় না বলে ভাইফোঁটায় বাপের বাড়ি যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছেন ময়ূরেশ্বরের ছামনার পূর্ণিমা দাস। পরিবারের চোখে ‘বড়’ হয়ে গিয়েছে পূর্ণিমাদের ভাইরা। আর ভাইরা বড় হয়ে গেলেই তাদের কপালে ফোঁটা দেওয়ার সুযোগ হারান পূর্ণিমারা। জীবন-জীবিকার তাগিদ কেড়ে নেয় ভাইকে ফোঁটা দেওয়ার আনন্দ।
শুধু বাণী বা পূর্ণিমারই নন, এই আক্ষেপ কার্যত অধিকাংশ ঢাকি পরিবারের। ওই সব পরিবারের ছেলেরা একটু বড় হলেই বাবার ঢাকের সঙ্গে কালীপুজোয় কাঁসর বাজাতে দূর-দূরান্তে যেতে শুরু করে। অধিকাংশেরই ফিরতে ভাইফোঁটা পেরিয়ে যায়। এ বারও তার অন্যথা হয়নি। গত চার বছর ধরে বাবা-কাকাদের সঙ্গে কাঁসর বাজাতে যাচ্ছে কুমিড়ার অষ্টম শ্রেণির ছাত্র কৃষ্ণ দাস। এ বারও তারা গিয়েছে দিল্লি। তাই মন ভাল নেই দিদি, দশম শ্রেণির ছাত্রী বাণীর। তার আক্ষেপ, ‘‘ভাইটা একটু বড় হওয়ার পরেই বাবা-কাকারা ওকে কাঁসি বাজাতে নিয়ে চলে যায়। আপন বলতে আমার তো একটাই ভাই। তাই আর আমার ফোঁটা দেওয়া হয় না। ফোঁটার দিন অন্যেরা যখন ভাইকে ফোঁটা দেয় তখন খুব মনখারাপ করে।’’
একই অভিব্যক্তি ছামনার বধূ পূর্ণিমা দাসেরও। তাঁর বাপের বাড়ি স্থানীয় রামকৃষ্ণপুরে। তিন বছর ধরে তারও একমাত্র ভাই, সপ্তম শ্রেণির ছাত্র অভিজিৎকে বাবার সঙ্গে কাঁসর বাজাতে যেতে হয়। এ বার তারা গিয়েছে হাওড়া। তাই এ বারও বাপেরবাড়ি যাবেন না পূর্ণিমাদেবী। তিনি বললেন, ‘‘আমাদের অভাবের সংসার। ভাইফোঁটায় ভাইকে জামাপ্যান্ট কিনে দেওয়ার জন্য সারা বছর ধরে কিছু করে টাকা জমিয়ে রাখি। আগে প্রতি বছরই ভাইফোঁটায় বাপের বাড়ি যেতাম। কিন্তু তিন বছর ধরে ভাই বাবার সঙ্গে কাঁসর বাজাতে চলে যায়। তাই আর ওই সময় বাপেরবাড়ি যাই না।’’
ঢাকিরা জানাচ্ছেন, বৃত্তটা কিছুতেই সম্পূর্ণ হয় না। আজকের কাঁসি বাদক এক দিন ঢাকি হবে। তখন তার ছেলেকেও একই ভাবে কাঁসর বাজাতে যেতে হবে। কারণ, কাঁসর না হলে কেউ ঢাক নিতে চান না। তাই কালীপুজোর আগের দিন ছেলেকে নিয়ে মণ্ডপের উদ্দেশ্যে রওনা দেন তারা। বাড়ি ফিরতে ভাইফোঁটা পেরিয়ে যায়। কারণ অধিকাংশ বড় পুজো ‘স্পনসর’ করে বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা। তারাই পুজো মণ্ডপ থেকে ডেকে নিয়ে যান তাদের অফিসে। সেই সময় কিছু সামগ্রী বিক্রি হলে ঢাকিদের কিছু বখশিসও মেলে। তা ছাড়া সারা বছর তো কার্যত ঢাক নিয়ে বসেই থাকতে হয়। ‘‘তাই পুজো, ভাইফোঁটা দেখতে গেলে আমাদের তো পেট চলবে না,’’—বলছেন ঢাকিরা।
শুধু বোনেরাই নন, আক্ষেপ রয়েছে প্রবীণদের মনেও। এক সময় বাবার সঙ্গে কাঁসর বাজাতে গিয়েছেন কুমিড়ার ৬৫ বছরের সুনীল দাস। সুনীলবাবুদের পাঁচ ভাইয়ের একটিই বোন সুখী দাস। তাঁর বিয়ে হয়েছে লাভপুরে। সুনীলবাবু বলেন, ‘‘আমরা পাঁচ ভাই বলে পালা করে বাবার সঙ্গে কাঁসর বাজাতে যেতাম। কিন্তু যার যে বার যাওয়ার পালা পড়ত, তার কিছুতেই যেতে মন চাইত না। কারণ তার কপালে তো ফোঁটা জুটত না।’’ অন্য দিকে সুখীদেবী বলেন, ‘‘চার ভাইকে পেলেও যে বার যাকে ফোঁটা দিতে পারতাম না, তার জন্য ভীষণ মনখারাপ করত। দরজার চৌকাঠে তার নামে ফোঁটা দিয়ে যমের দুয়ারে কাঁটা দিতাম।’’
একই অভিব্যক্তি কুমিড়ারই বিশ্বনাথ দাস, লাভপুরের হারাধন দাসদেরও। তাঁরা বলেন, ‘‘জীবিকার তাগিতে ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে আসি বটে। কিন্তু যখন শুনি বাড়িতে বাড়িতে ভাইয়ের কপালে ফোঁটা দেওয়ার পরে বোনেরা শাঁখ বাজাচ্ছে, উলুধ্বনি দিচ্ছে, তখন আমাদেরই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যায়। ছেলেগুলোও কেমন মনমরা হয়ে পড়ে। তখন নানা রকম আশ্বাস দিয়ে ওদের ভুলিয়ে রাখার চেষ্টা করি।’’