আকাশের নীচে। রঘুনাথপুর ২ ব্লকের লালপুরে। ছবি: সঙ্গীত নাগ
কয়েক কোটি টাকা খরচ করে গড়পঞ্চকোটের প্রত্নস্থল সংরক্ষিত করছে রাজ্য হেরিটেজ কমিশন। তাহলে কেন পুরুলিয়ার গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে থাকা প্রাচীন মূর্তিগুলির সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে না? এ দাবি উঠেছিল আগেই। সম্প্রতি পুরুলিয়া মফস্সল থানার পিঁড়রা পঞ্চায়েতের আনাই গ্রামের জৈন মন্দিরে জৈন তীর্থঙ্কর আদিনাথের মূর্তি চুরির পরে সেই দাবি আরও জোরালো হয়েছে।
পুরুলিয়া জেলার লোক গবেষকদের মতে, মন্দির থেকে মূর্তি চুরির ঘটনা অশনি সঙ্কেত। মূর্তি সংরক্ষণে অবহেলা করা হলে গ্রামে-গঞ্জে অবহেলায় পড়ে থাকা মূর্তিগুলো হারিয়ে যেতে সময় লাগবে না। সেক্ষেত্রে পুরুলিয়াতেই প্রশাসনের উদ্যোগে কোনও সংগ্রহশালা তৈরি করে সেখানে মূর্তি রাখার দাবি তুলেছেন লোকগবেষকেরা।
জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর জানাচ্ছে, তাদের দফতরের উদ্যোগে এই ধরনের সংগ্রহশালা রয়েছে কলকাতার বেহালায়। সেখানে অসংখ্য প্রত্নসামগ্রী রাখা আছে।
পুরুলিয়ার জেলা তথ্য ও সংস্কৃতি আধিকারিক সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘জেলায় সংগ্রহশালা তৈরি করা হবে কি না, তা সম্পূর্ণ ভাবে রাজ্য সরকারের সিদ্ধান্ত। সরকার জানালে পুরুলিয়াতেও ওই ধরনের সংগ্রহশালা করা যেতে পারে।”
তবে লোকগবেষকদের বড় অংশই জানাচ্ছেন, সংগ্রহশালা তৈরি করে মূর্তি ও প্রত্নসামগ্রী সংরক্ষণের এখনই প্রয়োজন। তাঁদের মতে, পুরুলিয়ার ১৭টি থানার নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা প্রত্নস্থল। প্রায় সব জায়গাতেই খোলা আকাশের নীচে অবহেলায় প্রত্নসামগ্রী পড়ে আছে। দুষ্কৃতীদের নজর সেখানে পড়াটা খুবই স্বাভাবিক।
রঘুনাথপুর ২ ব্লকের চেলিয়ামার বাসিন্দা লোকগবেষক সুভাষ রায়, পুরুলিয়া শহরের বাসিন্দা লোকগবেষক দিলীপ গোস্বামীরা জানাচ্ছেন, সাঁতুড়ির ধুলুরডি গ্রামে খোলা জায়গায় রয়েছে প্রাচীন দশভূজার মূর্তি। রঘুনাথপুর ২ ব্লকের লালপুরে অম্বিকা মূর্তি ও দু’টি জৈন মূর্তি রয়েছে। পাড়া ব্লকের দেউলভিড়ায় প্রচুর শিবলিঙ্গ ও পাড়া গ্রামে গড়ুর মূর্তি রয়েছে। পুরুলিয়া মফস্সল থানার এক গ্রামে পার্শ্বনাথের মূর্তি, তদগ্রামে জৈন সরস্বতী ও দুই জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি রয়েছে।
মানবাজারের বুধপুরে দু’টি গণেশ মূর্তি, পুঞ্চার পাকবিড়রায় সাত ফুট উচ্চতার জৈন তীর্থঙ্কর শীতলনাথের মূর্তি, তেলকুপির পাশে পাথরবাড়ি গ্রামে হাতির পিঠে থাকা চতুর্ভূজা দেবী মূর্তি তথা নীলকন্ঠবাসিনীর মূর্তি রয়েছে। শাঁকা গ্রামে তিন জৈন তীর্থঙ্করের মূর্তি, সিমড়া গ্রামের কাত্যায়নী মূর্তি ও গড়পঞ্চকোটের বিরিঞ্চিনাথ ধামে লকুলি শিবের মূর্তি রয়েছে। জয়পুরের নতুনডিতে সূর্যমূর্তি, আড়শা ব্লকে জৈন দেবদেবী, দেউলঘাটায় হিন্দু দেবদেবী ও তুম্বা ঝালদায় জৈন দেবদেবীর মূর্তি ছড়িয়ে আছে। তাঁদের দাবি, প্রায় ৯০০-১১০০ বছরের পুরনো এই সমস্ত মূর্তিগুলির শিল্পশৈলী নজরকাড়া।
পুরুলিয়ায় এত মূর্তি এল কী ভাবে?
লোকগবেষক সুভাষ রায়ের মতে, জৈন তীর্থঙ্কর মহাবীর তৎকালীন বজ্রভূমি অধুনা পুরুলিয়ার উপর দিয়ে জৈন তীর্থঙ্করদের নির্বানভূমি অধুনা ঝাড়খণ্ডের গিরিডির পরেশনাথ পাহাড়ে গিয়েছিলেন। তাই পুরুলিয়াতে জৈন ধর্মের প্রভাব পড়েছিল। পরে জৈন ব্যবসায়ীরাও তেলকূপি বন্দর থেকে বাণিজ্য করতেন। তাঁদের উদ্যোগেও জেলার বহুস্থানে জৈন মন্দির তৈরি হয়। তাই দেখা যায় জেলার বিভিন্ন জায়গায় পড়ে থাকা প্রাচীন মূর্তিগুলিতে জৈন স্থাপত্যের ছাপ খুবই স্পষ্ট।
দিলীপ গোস্বামীর দাবি, গবেষণায় দেখা গিয়েছে, জেলার ১৭টি থানার ১২২টি প্রত্নস্থলে পড়ে রয়েছে প্রাচীন নানা মূর্তি। সেগুলি দশম শতাব্দী থেকে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যে নির্মিত। যেগুলির মধ্যে স্থানীয় লোকজন বেশ কিছু মূর্তির রক্ষণাবেক্ষণ করছেন। কিন্তু সেগুলির সংরক্ষণ প্রয়োজন।”
তবে প্রাচীন মূর্তি চুরি আগেও ঘটেছে। লোকগবেষক সুভাষ রায়ের দাবি, আনাই গ্রামের মূর্তি চুরিই জেলায় প্রথম নয়। আগেও জেলার দেউলঘাটা, র্যালিবেড়া, লাখরা, পাকবিড়রা, দেউলভিড়ার মতো প্রত্নস্থল থেকে মূর্তি চুরি বা চুরির চেষ্টা ঘটেছে। সুভাষ বলেন, “অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে মূর্তি সংরক্ষণে আর দেরি করার সময় নেই।’’
ইতিহাস বাঁচাতে প্রশাসনের কি সাড়া মিলবে?