মেয়ের সঙ্গে পুনম। নিজস্ব চিত্র।
বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে সংসার করেছেন মাত্র মাস দুয়েক। অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে বাপের বাড়িতে থাকলেও স্বামীর সঙ্গে ক্ষীণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু কন্যাসন্তান জন্ম দেওয়ার পরেই সম্পর্কে ইতি টেনে দিয়েছেন স্বামী। কিন্তু হাল না ছেড়ে মেয়েকে মানুষ করার লড়াই জারি রেখেছেন মহম্মদবাজারের আদিবাসী তরুণী পুনম হেমব্রম।
লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে, নারী সমানাধিকারের জন্য বিশ্বজুড়ে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। ‘সমানাধিকার’ শুধু একটি শব্দ নয়, পুরুষদের সহায়তা ছাড়া জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার লড়াই লড়ছেন অসংখ্য মহিলা, প্রতিনিয়ত, নীরবে। পুনম তাঁদেরই একজন।
মহম্মদবাজারের ভূতুড়া পঞ্চায়েতের শুকনা গ্রামের বাসিন্দা ওই তরুণী মাধ্যমিক পাশ। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান পুনমের ২০১০ সালে বিয়ে হয়েছিল ঝাড়খণ্ডের দুমকার কাঠিজুড়িয়ার বাসিন্দা এক যুবকের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই জীবন ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করেছে তরুণীর। পুনম জানান, বিয়ের পরে কোনও সম্মান বা অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় যত্ন কিছুই পাননি তিনি। তাঁর স্বামী একদিনের জন্যও চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাননি, উলটে বাপের বাড়িতে রেখে দিয়ে যান। ইতিমধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান পুনমের বাবা। শুকনা গ্রামেই ২০১১ সালের এপ্রিলে তাঁর মেয়ের জন্ম হয়। স্বামী স্পষ্ট জানিয়ে দেন, মেয়ের দায়িত্ব তিনি নিতে পারবেন না। সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় দম্পতির।
তরুণীর কথায়, “বড্ড কষ্টে কেটেছে দিনগুলি। আমি, মা ও আমার সদ্যোজাত মেয়ে পড়েছিলাম অথৈ জলে। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে লড়াই চালাচ্ছি।” মেয়ে প্রিয়দর্শিনী এখন সিউড়ির একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। তবে পুনম তাঁর লড়াইয়ে সব সময় পাশে পেয়েছেন মা পুষ্পলতাকে। পুষ্পলতা গ্রামের একটি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের সহায়িকা। প্রাথমিক ভাবে তাঁর সামান্য বেতনে ভর করেই চলত তিনজনের সংসার। পুনমের মূল চাহিদা ছিল মেয়েকে ভাল স্কুলে পড়ানো। সিউড়ির একটি বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলেন মেয়েকে। পুনমের বাবার মোটরবাইকে চড়ে মা-মেয়ে প্রতি দিন সিউড়ি আসতেন। কিন্তু খরচ চালানো নাভিশ্বাস উঠছিল। ২০১৮ সালে বিজেপিতে যোগদান করেছিলেন। দল যেন তাঁর পাশে থাকে, এটুকুই আশা ছিল। সে বছর পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসকদলের বিরুদ্ধে মনোনয়ন জমা দেওয়ার জন্য মহম্মদবাজারে বিরোধীদের যে মিছিল হয়েছিল সেখানে সামনের সারিতে ছিলেন পুনম। তবে পুনমের প্রয়োজনের সময় দল নয়, পুলিশকে পাশে পেয়েছেন তিনি। পুলিশের উদ্যোগে মহম্মদবাজারের হরিণশিঙায় আদিবাসী কচিকাঁচাদের পড়ানোর জন্য তৈরি হয়েছিল পাঠশালা। সেখানেই শিক্ষিকার কাজ পান পুনম। বেতন পাঁচ হাজার টাকা। বড় স্কুলে আসার আগে আদিবাসী শিশুদের তৈরি করে দেওয়াই তাঁর কাজ।
মেয়ের সুবিধার্থে তিন বছর আগে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে সিউড়িতে এসে ওঠেন পুনমরা। ঘর ভাড়া সাড়ে তিন হাজার টাকা। সামান্য টাকা সম্বল করেই গড়ে তোলেন তিন প্রজন্মের সংসার। মেয়েকে বেসরকারি স্কুল থেকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করেন। গত তিন বছর ধরে সকালে সিউড়ি থেকে হরিণশিঙা যাওয়ার সময় মা-কে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে নামিয়ে দিয়ে যান। ততক্ষণ মেয়ে বাড়িতে একাই থাকে। তার স্কুলের সময়ের আগে ফিরে আসেন পুষ্পলতা। পুনম জানান, “মেয়ে সকালে মুড়ি-বিস্কুট খেয়ে থাকে। স্কুলে যাওয়ার আগে ভাত রান্না হয় না। ভরসা মিড-ডে মিল। ঘরভাড়া ও বাইকের তেলের খরচে মোট আয়ের অর্ধেক খরচ হয়ে যায়। যেমন করে হোক মেয়েকে মানুষ করতে চাই। মায়ের কাজ আর বেশি দিন নেই। তাতে যদি পাথর খাদানে কাজ করতে হয় করব।”