শর্মানী দাস। — নিজস্ব চিত্র।
ফের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নিজের ‘প্রাণ’ ফেরানোর আর্জি জানিয়ে চিঠি পাঠালেন ময়ূরেশ্বর থানা এলাকার আর এক বিধবা। ভোটার তালিকা, রেশন কার্ডে বেঁচে থাকলেও বছর খানেক আগে বিধবা ভাতার তালিকায় ৯২ বছরের ওই বৃদ্ধাকে মেরে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ। এর ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে তাঁর বরাদ্দ ভাতাও। তাই চরম অনটনে দিন কাটছে তাঁর। শুধু তাই নয়, প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরলেও তাঁর প্রাণ ফেরানোর কোনও ব্যবস্থা হয়নি বলে অভিযোগ। তাই শেষমেশ মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন শর্মানী দাস।
শর্মানী দাস ময়ূরেশ্বরের ঢেকা পঞ্চায়েতের কুলিয়াড়া গ্রামের বাসিন্দা। বছর কুড়ি আগে স্বামীকে হারিয়েছেন। তারপর থেকেই তিনি নানা হারে বিধবাভাতা পাচ্ছিলেন। ৭৯ বছর বয়স অতিক্রান্ত হওয়ার পর ওই ভাতার পরিমাণ দাঁড়ায় মামে ১০০০ টাকা। অভিযোগ, প্রশাসনের গাফিলতিতে বছর খানেক ধরে তাঁর ওই বন্ধ হয়ে রয়েছে। এরই মধ্যে তিনি পড়ে গিয়ে হাঁটাচলার ক্ষমতাও হারিয়েছেন। বার্ধক্যজনিত কারণে নিয়মিত নানা ওষুধ খেতে বলেছেন চিকিৎসকেরা। তিনি বলেন, ‘‘অর্থাভাবে তাও বন্ধ। দু’বেলা খাবারই জোটে না। ওষুধ কিনব কী করে? ভাতার টাকাটুকুই বাঁচিয়ে রেখেছিল।’’ বর্তমানে ওই বৃদ্ধা থাকেন ছোট ছেলে কাশীনাথের কাছে। তারও অভাবের সংসার। গ্রামে গ্রামে ভাঙা গৃহস্থালির সরঞ্জাম সারাই করে ৭ সদস্যের সংসার চালান কাশীনাথ। তিনি বলেন, ‘‘এমনিতেই নুন আনতে পান্তা ফুরনোর হাল সংসারে। কষ্ট করে সব দিক সামাল দিতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনের সকল স্তরে জানিয়েও কোনও ব্যবস্থা হয়নি। তাই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠাতে বাধ্য হয়েছি।’’ চিঠিতে বৃদ্ধা লিখেছেন, ‘আপনার প্রশানের গাফিলতিতে আমি মরে গিয়েছি। তাই আমার ভাতা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পড়ে গিয়ে আমি দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী। নিয়মিত নানা ওষুধ খেতে হয়। আমার ছেলের যৎসামান্য পেটের ভাতই হয় না, তাই ওষুধ জোটে না। আমার ছেলে প্রশাসনের দরজায় দরজায় ঘুরে হয়রান হয়ে পড়েছে। কেউ কথা কানে তোলেনি। তাই আপনার দ্বারস্থ হতে বাধ্য হলাম।......।’
জেলা পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন আধিকারিক মনীশ ভার্মা বলেন, ‘‘শুধু ওই বৃদ্ধাই নয় , পঞ্চায়েতের ভুল নবীকরণ রিপোর্টের জন্য জেলায় প্রায় ২০০ জীবিত উপভোক্তার ভাতা বন্ধ হয়ে রয়েছে । মাস ছয়েক আগে আমরা ওইসব উপভোক্তাদের ভাতা ফের চালু করার জন্য রাজ্য সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় রিপোর্ট পাঠিয়েছিলাম । কিন্তু কোন নির্দেশ না আসায় এখনও কিছু করা যায়নি।
নিয়মানুযায়ী বিধবা কিংবা বার্ধক্য ভাতার মতো সরকারি অনুদান ধারাবাহিক ভাবে পাওয়ার ক্ষেত্রে পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর থেকে বছরে এক বার উপভোক্তাদের তালিকা নবীকরণের জন্য সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েতে জন্য পাঠানো হয়। সরেজমিন খোঁজ নিয়ে উপভোক্তা কে? তিনি বেঁচে আছেন কি নেই?— উপভোক্তা সম্পর্কে এই সব তথ্য তালিকায় ঠিক করে ব্লকের মাধ্যমে পাঠাতে হয় পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরে। ইতিমধ্যে কোনও উপভোক্তার মৃত্যু হলে তার রিপোর্টও পাঠাতে হয়। ওই নবীকরণ এবং রিপোর্টের ভিত্তিতেই বজায় থাকে ভাতার ধারাবাহিকতা। প্রশাসনেরই একটি সূত্র জানা গিয়েছে, অনেক সময় সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত কর্মীরা অফিসে বসেই নবীকরণের দায়িত্ব সারেন। লোকমুখে এক রামের মায়ের মৃত্যু সংবাদ শুনে গ্রামেরই জীবিত থাকা অন্য এক রামের মাকে মৃত দেখিয়ে দেন। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, জীবিত থাকা রামের মায়ের ভাতা বন্ধ হয়ে গিয়েছে, আর অন্য রামের মায়ের নামে পাশবইয়ে ভাতার টাকা ঢুকেছে। রাজনৈতিক কারণেও কোথাও কোথাও ইচ্ছাকৃত ভাবে একই ঘটনা ঘটানো হয় বলে অভিযোগ। সংশ্লিষ্ট ঢেকা পঞ্চায়েতের প্রধান তৃণমূলের মিঠু গড়াই অবশ্য ওই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘‘কী করে এমনটা হল বুঝতে পারছি না। তবে বিষয়টি জানার পর ভুল সংশোধনের জন্য ব্লক প্রশাসনের কাছে প্রয়োজনীয় রিপোর্ট পাঠিয়ে দিয়েছি।’’ ঘটনাচক্রে ওই গ্রামেই বাড়ি স্থানীয় ময়ূরেশ্বর ২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি তৃণমূলের কল্যাণী দাসের। তিনি বলেন, ‘‘ওই বৃদ্ধা সত্যিই গরিব এবং অসুস্থ। পঞ্চায়েতের এক প্রাক্তন কর্মী ভুল রিপোর্ট পাঠানোর জন্যই এমনটা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছে।’’
এর আগেও ওই ব্লকেরই দাসপলশা পঞ্চায়েত এলাকার দুই বিধবা একই অভিযোগে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। ময়ূরেশ্বর ২ ব্লকের বিডিও সৈয়দ মাসুদুর রহমান বলেন, ‘‘ভুল সংশোধন করে ওই বৃদ্ধার ভাতার জন্য প্রয়োজনীয় রিপোর্ট ইতিমধ্যেই জেলা গ্রামোন্নয়ন দফতরে পাঠানো হয়েছে। আশা করছি শীঘ্রই বকেয়া-সহ ভাতার টাকা পেয়ে যাবেন তিনি।’’